প্রকাশিত:
১২ নভেম্বার ২০২৩, ২২:২৪
পরীক্ষা দিতে এসে শুরুতেই কঠিন প্রশ্ন পাবেন তা হয়তো নাজমুল হোসেন শান্ত ভাবতেও পারেননি। সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ম্যাচে নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন শান্ত। পুনেতে ভারতের বিপক্ষেও সাকিব ছিলেন না। ছিলেন না অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও। ম্যাচ হারের পর সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই শান্তর কোর্টে প্রশ্ন, ‘ব্যাটিং অর্ডারের অস্থিরতায় বাংলাদেশ ভুগেছে কিনা?’
শান্ত নিজের প্রথম উত্তরে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ব্যাটিং অর্ডারই সব সর্বনাশের কারণ! পরবর্তীতে তাকে চেপে ধরে নতুন প্রশ্ন করা হলে, রাগঢাক না রেখে বলে দিতে বাধ্য হন, ‘বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডার রদবদল অনেকবার হয়েছে।’ মুখ ফুটে বলতে না চাইলেও শান্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ব্যাটিং অর্ডার বারবার পরিবর্তনের কারণেই টুর্নামেন্টে গড়বড় হয়েছে। যে কারণে ভুগেছেন ক্রিকেটাররা। সম্ভাবনাময় বিশ্বকাপের সলীল সমাধি দেওয়া হয়ে যায় টিম ম্যানেজেমেন্টের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সব হারিয়ে এখন বোধোদয় হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টের।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। ধর্মশালায় যে পরীক্ষা শুরু হয়েছিল তা থামে কলকাতায়, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ হেরে। সেদিন ক্রিকেটের নন্দনকাননে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ হারের পর ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ মহল থেকে চাপ দেওয়া হয় ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন না আনার। পাকিস্তানের বিপক্ষে তাৎক্ষণিক সাফল্য না মিললেও শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে সুফল পায় দল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৩০৬ রান তোলে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৮০ রান তাড়া করে জয় পায় ৫৩ বল আগে ৩ উইকেট হাতে রেখে।
বিশ্বকাপে নয় ইনিংসে তিনটিতে চারে ব্যাটিং করেছেন শান্ত। বাকি সময়ে তিনে। শান্ত তাও নিজের জায়গায় থিতু হয়েছেন। বাকিদের নিয়ে হয়েছে টানাটানি। তাতে দল যে ভুগেছে তা স্পষ্ট শান্তর কথাতেই, ‘আমরা যেভাবে এসেছিলাম ওই জায়গায় যদি একই রকম থাকতো (ব্যাটিং অর্ডার) ভিন্ন কিছু হলেও হতে পারতো। আমার মনে হয় না যে, ওইটা হলেই যে আমরা সফলতা পেয়ে যেতাম। এটাও ঠিক না। আবার একই রকম থাকলেও সফলতার পরিমানটা অনেক সময় বেশি থাকে।’
বিশ্বকাপ মঞ্চে সবচেয়ে বেশি টানাটানি হয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৩ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ৫৭ রান করেন। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচে। এরপর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনে, ভারতের বিপক্ষে চারে। সেখান থেকে এক লাফে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাতে। পরের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তিনে আসার পর থেকে লেট অর্ডারে শেষ তিন ম্যাচে ব্যাটিং করেছেন মিরাজ। লাহোরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টপ অর্ডারে নেমে সেঞ্চুরি পাওয়ায় তার ওপর আস্থা অর্জন করেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। ওই দলের বিপক্ষেই পরিকল্পনা স্থির ছিল। কিন্তু বাকিদের বিপক্ষে সব ওলটপালট।
বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার নয়, যেন ভাগ্য খোলার মঞ্চ! রবি শাস্ত্রী পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ধারাভাষ্যের সময় বেশ কটাক্ষ করেই বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম একটা ঝুঁড়ি আছে। যেখানে সব ব্যাটসম্যানের নাম আলাদা করা কাগজ রয়েছে। প্রত্যেকে ওখান থেকে কাগজ উঠায়। যার নাম আসে সে-ই চলে আসে ব্যাটিংয়ে।’
অথচ ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ছিলেন ‘একগুয়ে’। সাকিব দেশে থাকতে এক সাক্ষাৎকারে বলে গিয়েছেন, প্রত্যেককে যে কোনো ব্যাটিং পজিশনে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর হাথুরুসিংহে সরাসরি বলেছেন, ‘যাকে যেখানে নামানো হচ্ছে সেটা দলের প্রয়োজনে।’ কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা ২২ গজে কাজই করছে না।
৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড় ও ৯১.৬২ স্ট্রাইকরেটে ৩২৮ রান করা মাহমুদউল্লাহ এই বিশ্বকাপে দলের সফলতম ব্যাটসম্যান। এছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান ৩০০ রানও করতে পারেননি। এই ব্যর্থতার পেছনে স্কিল ও মানসিকতার ঘাটতি তো ছিলই। সঙ্গে ক্রমাগত রদবদল বড় প্রভাব রেখেছে। এক-দুইটি পজিশনে অদলবদল হয়ে ব্যাটিংয়ের চিত্রটাই পাল্টে গেছে। শান্ত তাই বারবার ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তনের বিপক্ষে। দলের ভালোর জন্য কোচ ও অধিনায়কের বিপক্ষেই আওয়াজ তুললেন, ‘না করলেই ভালো (ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন) । কিছু কিছু দলের বিপক্ষে অনেক সময় করতে হয়, ওই দলের স্ট্রেংথ অনুযায়ী। তবে যত কম করা যায় তত ভালো। এই বিশ্বকাপে অনেক বেশি করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ দলের স্ট্রেংথ অনুযায়ী করা হয়েছে।’
শেষ কয়েক বছরের ঘটনাগুলোও বেশ প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর সাকিব এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফেরার পর তাকে তিন নম্বরে খেলানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে টিম ম্যানেজমেন্ট। শুরুতে চারে, পরে পাঁচেও দেখা যায় বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে। অথচ তিনে খেলে সাকিব ৬০৬ রান করেছেন এক বিশ্বকাপেই। অধিনায়ক হওয়ার পর নিজেকে কেন তিন নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ের জন্য বিবেচনা করেননি সাকিব সেই প্রশ্নও তাকে করা হয়েছিল?
উত্তরে সাকিব সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের দিকেই আঙুল তুলেছেন। বলেছেন, ‘২০১৯ বিশ্বকাপের পর যখন আমি নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসি তারপরও তো আমাকে তিন নম্বর পজিশনে খেলানোর জন্য চেষ্টা করানো হয়নি। যখন একজন খেলোয়াড় শেষ দুই বছর ধরে চারে ও পাঁচে ব্যাটিং করে আসছে তার হুট করে উপরে যাওয়া এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়া একটু কঠিন। সব সময় ওরকম চ্যালেঞ্জ নিতেও ভালো লাগে না। সেটাই একটা বড় কারণ আমি মনে করি আমার ওপরে ব্যাটিং না করার।’
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: