[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ ১৪৩১

মিডিয়া জনগণের কথা বলে না কেন?

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত:
৮ আগষ্ট ২০২৩, ২২:৫৪

ফাইল ছবি

গণমাধ্যম ওয়াসার তথ্যের লবন ডিজিটাল পাইপ দিয়ে ছড়াচ্ছে পুরো বিশ্ব। সেই লবনের ক্রিয়ায় বসবাসরতদের ব্লাডপ্রেসার মারাত্মকভাবে বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাড়ছে সমাজের হার্টঅ্যাটাক এবং স্ট্রোকের আশঙ্কাও। চারিদিকে স্বচ্ছতার আকাল, বিকল্প পাওয়া মুশকিল। তাই দশকের পর দশক অভ্যস্তরা বুঝতেও পারেনি এভাবে নিচতলার মানুষদের লবন খাওয়ানো হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সবাই জানে কে ট্যাংকে লবন দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ করলে হয় পরপার; নয়তো লবনের প্যাকেট গলাধঃকরণ ভাগ্যে জুটবে। তাই সবাই চুপ!

অনেকেই বলে “আগের যুগে রাজা বাদশাহরা লাঠিয়াল পুষত নিজের রাজ্য রক্ষা করতে। আর এখনকার ধনীকশ্রেণী মিডিয়া পোষে।” বাংলাদেশে করপোরেট সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে মিডিয়ার লবিং, ওকালতি, দালালি। মিডিয়া জনগণের কথা বলে না কেন? প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী, অন্যান্য ধর্মের কথা বলেনা কেন? এসব প্রশ্নে উত্তর জানতে হলে মিডিয়ার মালিকানা ও আদর্শ দেখতে হবে। দেখতে হবে বাইরের কোন এজেন্সির পেইড এজেন্ট কিনা। কিংবা দৃষ্টি দিতে হবে ঐ মিডিয়ার চরিত্র এবং মালিকানার কাঠামো।

একটু খুলে যদি বলা হয় তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায়, মিডিয়া ধনিক-মালিক শ্রেণির হাতিয়ার। এর কাজ হলো এলিট সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কথিত নারীবাদী, ঝোলবাদী, তেনাবাদীদের সাথে আমে-দুধে সম্পর্ক তৈরি। আরোও খোলা ভাবে বলতে গেলে পিট চুলকোচুলকি। তাহলে এর আদর্শ কি? উত্তর:- মুক্ত বাজার অর্থনীতি মিডিয়ার আদর্শ।

অর্থনীতির কিছু উদাহরণ দিলে বুঝতে পারা যায় মিডিয়ার চরিত্র। মিডিয়া সংস্কৃতি জনগণকে ব্যবসার মাধ্যম বানিয়েছে। এলিট বাদে সবাই তাদের প্রডাক্ট। খেয়াল করলে দেখবেন, লালন শিল্পীদের গায়ে সাদা কাপড়ে হুইল পাউডারের বিজ্ঞাপন, নারীর ক্ষমতায়ন দেখানো হয় স্বামী-পরিবারের অবাধ্যতা দেখিয়ে, বাচ্চাদের শক্তি দেখানো হয় দুধের কৌটাতে (মায়ের বুকের দুধে নয়), প্রচারিত নাটক-নাটিকাতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের জায়গা নেই, নেই আদিবাসী চরিত্র। এটার কারণ স্বাভাবিক-তাদের হাতে মিডিয়ার মালিকানা নেই। নারীদের খোল্লামখোলা করা হয় কারণ তারা হয় “বিকৃত” নয় “বিক্রীত”। কারণ একই- মিডিয়ার মালিক নারী নয়।

মিডিয়া সমাজের বিশেষ একশ্রেণীর কথা বলে তা প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে। জনস্বার্থের বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে গৌণ। মুখ্য হলো- মিডিয়ার মালিকদের মুনাফা অর্জন, বিদুৎ গতিতে ব্যবসায়িক উন্নতি, মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। এককথায় কর্পোরেট স্বার্থে নজর। এই একটা গন্ডি পেরিয়ে গণমানুষের কথা বলবে এটা ভাবার সুযোগ নেই- তারা যা করবে সবই নিজেদের স্বার্থে। তেলের এডে দেখেবেন একটা মাছ কম ভাজে! কেন? সন্তান বেশি নেওয়া যাবে না, অনু পরিবার গড়ে তোল, পিতা-মাতা আলাদা থাকলেই ভালো। এটিও এক এজন্ডা বান্তবায়ন কিনা ভাবতে হবে।

হতদরিদ্র কুমারীটি মা হয়েছে, সংগ্রামী নারী ধর্ষণের শিকার, মামুনুলের রিসোর্ট কান্ড, মুনিয়ার ৬ বয়ফ্রেন্ড, বিএনপি নেতার ফোনালাপ ফাঁস, আ’লীগ নেতার স্ক্যান্ডাল ভাইরাল এসব কেন নিউজ হয় জানেন? কারণ ক্লাইমেক্স থাকে। দেশের ৯৯ ভাগ নারীর সংগ্রামী আর বঞ্চিত জীবনের স্থান মিডিয়ায় নেই। নেই বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবনের গল্প। তারা যে করেনা তাও নয়, করে ঠিকই সেটা একটা প্রলেপ। এ প্রলেপ হলো ভালোদের বিভ্রান্ত করার সু-কৌশল। মাঝে মধ্যে দেখবেন সরকারের টাকায় পরিচালিত মিডিয়া হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর ছেপেছে!


এখন গণমাধ্যমের লেখা বা টেক্সট মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। মিডিয়া নিরপেক্ষতার ধোঁয়া তুললেও মূলত আধিপত্য আর ক্ষমতাশীল শ্রেণির মতাদর্শকেই বহন করে। দম্পতির বিসিএস পরিক্ষায় পাস, জিপিএ পেলো ভ্যানচালকের মেয়ে, ডাক্তার হতে চায় ঝালমুড়িওয়া সজীব। এগুলো আপামর জনগণের “মস্তিস্ক প্রক্ষালন”। মাস্টার্স পাস করা ছেলেটা জানেনা দেশের কোন বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চাকরির সুযোগ কতো ভাগ। বিসিএসের মুলা বুঝিয়ে বেকার তৈরির কারখানা চালু রাখা মূল উদ্যেশ্য। শত শত কোটি টাকা লাভ আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, শিক্ষার্থীরা পায় কাঁচকলা। কারণ, বোঁকা উৎপাদন করলেই কেবল শাসন ও শোষণ উভয়ই চালু থাকবে।

বুদ্ধিজীবী সংবর্ধনা, গান, নাচ নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মেলা, উচ্চশিক্ষা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, সাহায্যের হাত বাড়নো, দান-খয়রাত সবকিছুই পুঁজির অক্সিজেন দিয়ে চলে। আর এসবের ডান হাত মিডিয়া। একথায় আধিপত্যের খড়গের নিচে জনগণ। দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি কিংবা নিজের প্রচার-প্রচারণা করতেই তৈরি করেছে এক-একটি মিডিয়া। কোন না কোন গ্রুপের সবগুলো মিডিয়া। তাহলে, মায়ের কাছে নানির বাড়ির গল্প করে কতটা লাভ আছে ভাবতে থাকুন!

তবে হ্যাঁ, কোন মিডিয়া স্বাধীন থাকতে পারে না। কর্মীদের পেট তো আর সততা দিয়ে ভরবে না। নৈতিকতা আর অর্থ আলাদা জিনিস। কোন গ্রুপ কিংবা মতাদর্শের উপর ভর করেই মিডিয়াকে চলতে হয়। আয়ের উৎস তৈরি করতে অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনভাবে মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। সারাবিশে^র মিডিয়াগুলো কর্পোরেট। সেখানে বাংলাদেশে ভিন্ন হবে এটা ভাবাও বোঁকামি।

গণমাধ্যমের এটাও খেয়াল করা প্রয়োজন যে সম্পাদকীয় নীতিমালায় শুধু পত্রিকা চলে না। জনগণও সেটা ঠিক করে দেয়। কোন পত্রিকা জনগণ পড়বে আর কোনটা প্রত্যাক্ষাণ করবে সেটার জন্য বৃহৎ গোষ্ঠী বসে আছে। কাজেই ন্যায় ও অন্যায়ের তুলনামূলক সমতা রাখা জরুরি। যদিও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রসারে মিডিয়ার তথ্যের অপেক্ষায় থাকেনা জনগণ। এদিকটিও নজর রাখা প্রয়োজন মিডিয়াগুলোর।

ইচ্ছার মহাশ্মশান হলো মন। প্রতিদিন অসংখ্য ইচ্ছাকে এখানে পুড়াই। তরুণ সাংবাদিকদের সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে গণমাধ্যমের যে নগ্ন রুপ জাতির কাছে উন্মোচিত হয়েছে তা বড়ই কদাকার-বিশ্রী। তাহলে কি গণমাধ্যম স্বর্পেন বধ্যভূমি? নাকি গোরস্তান?

নগরের সবচেয়ে বড় ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে সব নোংরা যখন রাস্তায় মিছিল করছে ঠিক তখনই ড্রেনে নামতে হয়। নাক সিটকে দূরে সরে গেলে রেহাই পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ নামবেই পুরো নগরীর মানুষকে বাঁচাতে। সেটা হতে পারে তরুণ সাংবাদিকেরা। আজ মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে এতটুকু চাওয়া তো থাকতেই পারে।

 

লেখক

মেহেদী হাসান

সভাপতি, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি

 

 

বাংলা গেজেট/এমএএইচ


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর