[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ ১৪৩১

গুজবের পাখায় এত জোর কেন?

হারুন উর রশীদ

প্রকাশিত:
১১ আগষ্ট ২০২৩, ২৩:০৫

প্রতীকী ছবি

‘গুজবের পাখা আছে’ এই প্রবাদ আমরা সবাই জানি। কিন্তু সত্যের পাখা আছে—এমন প্রবাদ কখনো শুনিনি। শুনেছি, সত্যের আছে শক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্য জানার পরও মানুষ তা কেন বিশ্বাস করে না? কেন গুজবে কান দেয়?

এই প্রশ্নের জবাব আপনার আমার সবার জানা আছে। তারপরও একটু ঝালাই করছি। নতুন করে চর্চা করার জন্য মনে করিয়ে দেই। আর কিছু প্রশ্নের মধ্য দিয়ে জবাব খোঁজার চেষ্টা করি।

১.ঈশপের সেই গল্প আমরা কে না জানি! সেই মেষপালক বালক। যে প্রতিদিনই নেকড়ে আসার মিথ্যা গল্প বলে চিৎকার করতো। আর তার এই মিথ্যা চিৎকারে লোকজন জড়ো হলে সে মজা করতো। কিন্তু সত্যি যেদিন নেকড়ে এলো, সেদিন কিন্তু সত্য চিৎকারেও গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে আসেনি। তারা সত্যকে মিথ্যা ভেবেছিল।

২. কয়েক মাস আগে দেশে ছেলেধরা গুজবে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। এমনকি সন্তানের জন্য স্কুলের খোঁজ নিতে গিয়ে মাকেও জীবন দিতে হয়েছে। এই যারা ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়েছে, তারা কি কারুর পূর্বশত্রু? যদি তাই না হবে, তাহলে তারা এটা কেন করলো? আস্থার সংকটে। প্রকৃত অপরাধেও প্রতিকার না পাওয়ার কারণে এই সংকট তৈরি হয়। মানুষ তাই নিজেই বিচারক হতে চায়। গুজবকেই তার কাছে সত্য মনে হয়।

৩. পেঁয়াজ নিয়ে যে সংকট তৈরি হলো, তাতে কি প্রকৃত তথ্য জানতে পেরেছে ভোক্তারা? প্রকৃত চিত্র কি সাধারণ মানুষকে জানানো হয়েছে? সারা দুনিয়া থেকে পেঁয়াজ আসছে, আসছে বলা হলো। কিন্তু আসতে যতদিন লাগার কথা বলা হয়েছে, ততদিনে কি এসেছে? মঙ্গলবারের বিমান পেঁয়াজ নিয়ে কবে আসবে? বুধবারে বিমান এসেছে মিশর থেকে, কিন্তু পোঁয়াজ আসেনি। একটি দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা এই খবরটুকুও সঠিকভাবে দিতে পারেন না! তাহলে কোনটা গুজব আর কোনটা সত্য, বুঝবো কীভাবে?

৪. এরমধ্যে আবার লবণ গুজব। যারা গুজব ছড়িয়েছেন তারা ভালো করেই জানতেন এখন গুজব ছড়ানোর উর্বর সময়। কারণ, অস্থিরতার মধ্যে মানুষ গুজব বিশ্বাস করে। প্রকৃত তথ্য পেতে এখানে সময় লাগে। অথবা পাওয়া যায় না। আর সেই ফাঁকে যা হওয়ার হয়ে যায় লবণ সংকটের ১২ ঘণ্টার গুজবেও যাদের ব্যবসা তারা কিন্তু ঠিকই করেছেন।

এই লবণ গুজবেরই একটা ইতিবাচক দিকও আছে। আর সেটা হলো গুজবের বিপরীতে মানুষকে প্রকৃত তথ্য যত দ্রুত বিশ্বাসযোগ্য ও সংগঠিতভাবে দেওয়া যায়, ততই দ্রুত গুজব পাখা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। লবণ গুজবের বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টা ছিল সংগঠিত ও স্বার্থক। সাধারণ মানুষও এই গুজবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যারা লবণের সরবরাহকারী, তাদেরই গুজবের বিরুদ্ধে মাঠে নামানো ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।

একইভাবে ছেলেধরা গুজবের পর ‘হারপিক’ কমোডে ঢেলে মশা মারার গুজব কাজে আসেনি। কারণ হারপিক প্রস্তুতকারকরাই বলেছেন, হারপিক মশা মারার জন্য নয়।
তাহলে এটি স্পষ্ট যে, সব সময় সঠিক তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করাই হলো গুজব প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়। মানুষ যদি না জানতে পারে প্রকৃতই কী হচ্ছে, তাহলে তো গুজব ছড়াবেই। সঠিক তথ্য না পেলে এই গুজবের পাখা এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তখন মানুষ সত্যকেও বিশ্বাস করে না। সত্যকে মিথ্যা ভেবে গুজবকে সত্য ভাবে।

এখানেই আসে স্বচ্ছতার প্রশ্ন। রাষ্ট্রের সব ধরনের কাজে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। নাগরিকদের কাছে যদি তথ্য গোপন করা হয়, তারা যদি তথ্য জানতে না পারে, তাহলে তারা নিজেরাও কল্পনার নানা বেলুন ওড়াতে থাকেন। হয়তো সে সবেরই কোনও একটি গুজব হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমর হয়তো রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু সত্য তো আর ঢুকতে পারবে না। আর তাই যদি হয়, তাহলে গুজবের পাখায় জোর তো বাড়বেই।

তাহলে সঠিক তথ্য নাগরিকরা কীভাবে পাবে? এর একটি অন্যতম পথ হলো সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যম যদি স্বাধীনভাবে সঠিক তথ্য সব সময় তথ্য পরিবেশন করে, তাহলে মানুষ তাদের তথ্য বিশ্বাস করবে। কিন্তু সবসময় সেটা না করে শুধু গুজবের সময় সত্য তথ্য প্রকাশ করলে মানুষ সহজে তা বিশ্বাস করবে না। যখন করবে তার আগেই তখন ‘গুজবের ব্যবসা’ শেষ হয়ে যাবে।

এখানেই আস্থার জায়গাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যম যদি মানুষের আস্থায় না থাকে, যদি আস্থা ধরে রাখতে না পারে, তাহলে তাদের দেওয়া সঠিক তথ্যকেও মানুষ সঠিক মনে করে না। গুজবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর যারা গুজব ছাড়ায় তারা সেই সুযোগ নেয়। আস্থা একদিন বা এক মাসের কোনও বিষয় নয়। এটা দীর্ঘ সময়ের সততা ও স্বাধীনতার চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। সাত দিন ‘দালালি’ আর সাত দিন আবার ‘নিরপেক্ষ’ এটা যারা ভাবেন, তারা ভুলের মধ্যে আছেন। সুবিধা নিতে কিছু তথ্য গোপন করা আবার সুবিধা বুঝে কিছু তথ্য প্রকাশ করার মাধ্যমে আস্থায় আসা যায় না। এটি আসলে প্রতারণা। প্রতারকের সত্য কি বিশ্বাস করা যায়?

এই আস্থার বিষয়টি রাষ্ট্র ও সরকারের জন্যও। সরকার যদি সাধারণ মানুষের আস্থায় না থাকে, তাহলে তাদের সত্য কথায়ও মানুষ ভরসা পায় না। আস্থা রাখতে পারে না। আবার রাষ্ট্রযন্ত্র যদি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ও সকারের এই আস্থার বিষয়টিও কখনও একদিনের নয়, দীর্ঘকালের কাজের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। নয়তো মেষ পালকের সত্যের মতো ব্যর্থ হয়, প্রকৃত সত্যকেও মানুষ মিথ্যা মনে করে। গুজবের পাখা আরও জোর পায়।

আপনার যারা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ক্ষিপ্ত, যারা বলেন ফেসবুক গুজব ছড়ায়, তাদের বলি, ফেসবুক কিছুই ছড়ায় না। আমরাই ফেসবুকে ছড়াই। আস্থার পরিবেশ তৈরি হলে ওখানেও গুজব ছাড়াবে না। ছড়ালেও তা টিকতে পারবে না। আর যখন ফেসবুক ছিল না তখন কি গুজব ছিল না?

পাদটিকা: সঠিক তথ্য কী বলা হলো, তার চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হলো, সেটা কে বলছেন। ব্যক্তি, সংবাদ মাধ্যম, সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্র যদি মানুষের আস্থায় না থাকে তাহলে তাদের বলা সঠিক তথ্যেরও জোর থাকে না।


লেখক: সাংবাদিক


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর