প্রকাশিত:
২ ডিসেম্বার ২০২৩, ১০:৫৩
পাঁচ-ছয় মাস আগে পুঠিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনার পর ১৫ বছর বয়সী এক মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভর্তি করা হয় নিউরোসার্জারি (৮ নম্বর) ওয়ার্ডে। সেখানে তার সেবাশুশ্রূষা করার মতো কেউ ছিল না। মাথাসহ সারা শরীরে ছিল জখম।
এক হাত ও এক পা ভাঙা। নড়াচড়াও করতে পারছিল না মেয়েটি। বাড়ি কোথায়, স্বজন কে, কিছুই বলতে পারছিল না। পরদিন সকালে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে এসে এই খবর পেয়ে মেয়েটির কাছে ছুটে যান আলেয়া খাতুন।
তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। মেয়েটিকে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা সেবা দিতে থাকেন; আর তাকে গোসল করানো, তিন বেলা খাওয়ানো, বাথরুমে নেওয়াসহ সব ধরনের সেবাযত্ন করতে থাকেন আলেয়া। প্রায় চার মাস এভাবে চলার পর কিছুটা সুস্থ হলে মেয়েটি জানায়, তার নাম পারুল। ভাইয়ের নাম জাহাঙ্গীর।
এর বেশি কিছু এখনো বলতে পারে না। বর্তমানে অর্থোপেডিক (১ নম্বর) ওয়ার্ডে তার চিকিৎসা চলছে। সেখানেও তার সেবাশুশ্রূষা করছেন আলেয়া। অবশ্য আলেয়াকে মাঝেমধ্যে এই কাজে সহায়তা করেন আরো দু-তিন আয়া। শুধু পারুলই নয়, ১৫-১৬ বছর ধরে এই হাসপাতালে অজ্ঞাতপরিচয় বা স্বজনহীন যত রোগী এসেছে, তাদের প্রায় সবারই আস্থার ঠিকানা হয়েছেন আলেয়া।
এসব মুমূর্ষু রোগীর খাওয়ানো থেকে শুরু করে গোসল করানো, বাথরুমে নেওয়া, গায়ে মলম লাগানো, ওষুধ সেবন করানোসহ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই আলেয়া। নিজেই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। নিজের টাকা দিয়েই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীও কিনে দেন। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে চান না কিছুই। মানুষটাকে সুস্থ করে তুলতে পারলেই তাঁর মুখে হাসি ফোটে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের আরেক আয়া নিলুফার খাতুন বলেন, ‘আলেয়া সন্তান প্রসবকালীন যখন ছিল না, তখন আমরা তিনজন আয়া তিন বেলা অজ্ঞাত পারুলের সেবাযত্ন করেছি। কিন্তু তার পরও মেয়েটি শুধু আলেয়াকে খোঁজে। আলেয়া যেভাবে অজ্ঞাত রোগীদের দিনের পর দিন সেবাযত্ন করে, সেটি কেউ করতে পারবে না। তাকে দেখেই আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। কিন্তু আলেয়ার মতো পারব না। ও যেভাবে দরদ দিয়ে মানুষের সেবা করে, সেটি কেউ হয়তো পারবে না। আলেয়া অজ্ঞাত রোগীদের মনে করে আপন কেউ। সেভাবেই তাদের পাশে থাকে। এমন মানুষ এখন পাওয়া মুশকিল।’
গত বছর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন কুষ্টিয়া জেলা সদরের খাজাপুর গ্রামের আজিজ বেপারীর ছেলে আব্দুল আলিম (২২)। পরে আহত অবস্থায় তাঁকে পুলিশ উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। আলিমের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল যে তিনি তাঁর পরিচয়ও দিতে পারছিলেন না। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের চিকিৎসা আর আলেয়া সেবা দিয়ে আলিমকে সুস্থ করে তোলেন। হাসপাতালে ১৫ দিন থাকার পর আলিম তাঁর স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। নিজের নাম, ঠিকানা বলতে পারার পর তাঁকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মোহাম্মদ আলী (৬০)। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন। এরপর নগরীর বোয়ালিয়া থানা পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু আহত মোহাম্মদ আলী পরিচয় দিতে পারছিলেন না। তাঁকে সেবাদান করার মতোও কেউ ছিল না। এক দিন পরই খবর পেয়ে মোহাম্মদ আলীকে সেবা দিতে শুরু করেন আলেয়া। মোহাম্মদ আলী প্রায় এক মাস পর জ্ঞান ফিরে তাঁর পরিচয় দেন। পরে তাঁকে পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
হাসপাতালের আনসার সদস্যদের ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রায় সাত বছর ধরে আছি এখানে। হাসপাতালে যেসব অজ্ঞাত রোগী আসে, সেসব রোগী সাধারণত সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় আসে। এদের পথচারী, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন বা পুলিশ এনে রেখে যায়। এসব অজ্ঞাত রোগীকে ভর্তি করার টাকাও হয়তো কখনো আমার মতো ছোট কর্মচারীর পকেট থেকে যায়।
কিন্তু ভর্তি করার পর ওই রোগীর চিকিৎসার খরচ বা তার সেবা নেওয়ার মতো তো একজন মানুষের দরকার হয়। আর সেই কাজটি করে থাকেন আলেয়া। রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেসব ওষুধ থাকে না, সেই ওষুধ কিনতে আলেয়া ছুটে যান হাসপাতালের সমাজসেবা দপ্তরে। সেখান থেকে বা পরিচালক স্যারের কাছ থেকে অথবা নিজের কাছ থেকে টাকা দিয়ে রোগীর ওষুধ কিনে আনেন আলেয়া। এর বাইরে রোগীর সেবা তো করেনই।’
শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আলেয়া যেভাবে অজ্ঞাত রোগীর সেবা করে যাচ্ছে, সেটি বিরল। একজন আয়া হয়ে নিজের ঘর-সংসার ফেলে এসেও সে মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। তার এমন মহানুভবতা দেখে আমরা সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যাই।’
আলেয়া খাতুন জানান, তিনি ২০০৭ সাল থেকে যেসব রোগীর স্বজন আসে না, তাদের সেবাযত্ন করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ অজ্ঞাত রোগীর সেবাযত্ন করেছেন তিনি। সেবার পরে সুস্থ হয়ে যারা পরিচয় বলতে পেরেছে, তাদের নিজ উদ্যোগে বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আলেয়া বলেন, ‘আমার বাড়িতে ১২ বছর ধরে একজন রোগী আছে, যে তার ঠিকানা বলতে পারে না। প্রায় সাত বছর বয়সের একটি শিশু ট্রেনে কাটা পড়ে হাত-পা হারানো অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। সেখান থেকে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। ওই শিশুর নাম রেখেছেন বল্টু। সেই বল্টু এখন শিশু থেকে যুবক।’
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহমেদ বলেন, ‘আলেয়ার মতো এমন জনদরদি মানুষ পাওয়া মুশকিল। হাসপাতালের সব অজ্ঞাতপরিচয় রোগীকে নিয়ে আমরা আলেয়ার ওপর ভরসা রাখি। রোগীর সেবাযত্ন করার কথা বলতে হয় না তাকে। সে নিজেই ছুটে যায় এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ওই সব রোগীর সেবা করার উদ্দেশ্যে। সে না থাকলে আমরা এসব রোগী নিয়ে বিপদে পড়তাম।’
আলেয়া ব্যক্তিজীবনে তিন সন্তানের জননী। সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাঁর ছেলেসন্তান। বড় দুটি মেয়ে। তাদের একজন রাজশাহীর ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন নার্সিং কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় মেয়েটি নগরীর একটি বেসরকারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। আলেয়ার স্বামী বই-খাতা বাঁধাইয়ের কাজ করেন। আলেয়া ও তাঁর স্বামীর সামান্য বেতনে কোনো মতে চলে তাঁদের সংসার।
আলেয়া বলেন, ‘২০০৭ সালে আমি এই হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মচারী ছিলাম। হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে একজন অজ্ঞাত রোগীকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় ভর্তি করেছিল পথচারীরা। কিন্তু তাকে দেখা-শোনার কেউ ছিল না। আমরা দুজন আয়া যে যার মতো ডিউটি করে চলে আসতাম। একদিন সকালে গিয়ে দেখি লোকটা ছটফট করতে করতে একা একাই মারা গেল। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। চোখের সামনে এমন মৃত্যু দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছা জাগে আমি পরিচয় না থাকা এমন মানুষের পাশে থাকব।
সেই থেকে হাসপাতালের অজ্ঞাতপরিচয় রোগীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। স্যারেরাও এমন রোগী এলে আমাকেই খবর দেন। অন্যরা ঠিকমতো যত্ন নেন না বলে আমাকেই খবর দেওয়া হয়। আমি যে ওয়ার্ডেই থাকি না কেন, অজ্ঞাতপরিচয় রোগী এলেই আমার খোঁজ পড়ে। আমারও ভালো লাগে। মানুষের সেবা করতে করতে এটা আমার নেশা হয়ে গেছে। আমি আর বসে থাকতে পারি না।’ সূত্র: কালেরকণ্ঠ।
বাংলা গেজেট/এফএস
মন্তব্য করুন: