দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে দেশজুড়ে মাঠে নামে কৃষি বিভাগ। পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। চাহিদার সাথে সাথে বেড়েছে আবাদের পরিমান। তারপরও পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া। পেঁয়াজ আমদানি করতে গিয়ে ব্যয় হয় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তাই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে চাচ্ছে কৃষি বিভাগ। পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে চাষ হচ্ছে গ্রীষ্মকালিন চাষ।
রাজশাহী জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদকৃত জমির পরিমাণ ৫৩৮ হেক্টর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে দুর্গাপুরে। সেখানে ৭৯ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়। এছাড়া পবা উপজেলায় ৭০ হেক্টর, তানোর উপজেলায় ২০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ৫৩ হেক্টর, বাগমারা উপজেলায় ৫৯ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৭৫ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ৬৫ হেক্টর, চারঘাট উপজেলায় ৫৯ হেক্টর ও বাঘা উপজেলায় ৫৮ হেক্টর।
এরই মধ্যে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে মোট তিন হাজার জনকে কৃষি প্রদান প্রণোদনা দেয়া হয়। এর মধ্যে পবা উপজেলায় পেয়েছেন ৩৫০ জন, তানোর উপজেলায় ২০০ জন, মোহনপুর উপজেলায় ৩০০ জন, বাগমারা উপজেলায় ৫৫০ জন, দুর্গাপুর উপজেলায় ৩৫০ জন, উঠিয়া উপজেলায় ৩০০ জন, গোদাগাড়ী উপজেলায় ৫০০ জন, চারঘাট উপজেলায় ২৫০ জন ও বাঘা উপজেলায় ২০০ জন। এদেরকে এই পেঁয়াজের বীজ, সার, বীজতলা করার পলিথিনসহ অন্য উপকরণ চাষিদের বিনামূল্যে দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি বিভাগ বলছে, অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে বীজতলা তৈরি করা। এরপর বীজতলা থেকে চারা তুলে জমিতে রোপন করেছেন। আগামী জানুয়ারিতে বাজারে পাওয়া যাবে এই পেঁয়াজ।
কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় ১৬ হাজার ৭৯১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়। উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৯৯ মেট্রিক টন পেঁয়াজ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৯৯৩ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল।
চাষিরা বলছেন, খুব অল্প খরচে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি বিভাগও এখন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছে। পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় এবার অনেকেই পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন তাই দাম বেশি। প্রতিটি মানুষ বাড়ির আশেপাশে নিজেদের খাবারের জন্য পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। দ্রুত ফলন দেওয়ায় চাষিরা এখন এই পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকছেন। আর পেঁয়াজ চাষে ঠান্ডায় বিভিন্ন রকম রোগ-বালাই ঠেকাতে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাঠের পর মাঠজুড়ে পেঁয়াজের চারা রোপনে চাষিদের দম ফেলার সময় নেই। সারিবদ্ধভাবে পেঁয়াজ রোপন করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মাঠে- মাঠে সবাই দল বেধে লাইন করে সকাল থেকে বিকেল অব্দি। সবাই একসাথে পেঁয়াজের জমিতে বসে পেঁয়াজের চারা রোপন করছেন। এবার পেঁয়াজের দাম ভালো হওয়ায় জেলা জুড়ে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য সব ফসলের পাশাপাশি পেঁয়াজ চাষের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন চাষীরা।
গোদাগাড়ী উপজেলার মাদারপুর গ্রামের কৃষক জমসেদ জানান, গতবছর আমি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। কিন্তু পেঁয়াজের দাম না পেলেও এ বছরে পেঁয়াজের অনেক দাম থাকায় এবারে ৩ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগাচ্ছি।
পবা উপজেলার পেঁয়াজ চাষি তৌহিদুল ইসলামের ছেলে মো. আলামিন বাবার কাজে সাহায্য করছেন। তিনি জানান, স্কুলের পাশাপাশি পেঁয়াজ লাগানোর কাজ করছি। পেঁয়াজ লাগিয়ে প্রতিদিন তিন থেকে চারশ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এই টাকা দিয়ে বই খাতা খরচ ও সেই সাথে পরিবারের কিছু সাহায্য করতে পারছি।
বাঘা উপজেলার দুর্গম পদ্মার চরে রোপন করা খায়েরহাট এলাকার কৃষক আবদুস সালাম পেঁয়াজের জমি দেখছিলেন। সালাম জানান, চলতি মৌসুমে পদ্মার পানি আগে নেমে যাওয়ায় পেঁয়াজ আগাম রোপন করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের বাজারমূল্য ভালো পাবেন বলে আশা করছেন। পদ্মার চরে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। এবার পদ্মার পানি আগে নেমে যাওয়ার কারণে চলতি মৌসুমে আগাম পেঁয়াজ চাষ করা হয়েছে। গত বছর তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে বাজারমূল্য ভাল পেয়েছিলেন। এবারও আশানুরূপ দাম পাবেন বলে জানান।
রাজশাহী জেলায় পেঁয়াজের চাহিদা মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। আর প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে জোর দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহীতে এই পেঁয়াজ চাষের আগ্রহ বাড়ছে। এতে প্রত্যাশার চেয়েও ভালে ফলাফল পাওয়া গেছে। আগামীতে চাষ আরও বাড়বে। এ বছর জেলার সবখানেই কমবেশি পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। সমতল এলাকার চেয়ে বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় পদ্মার চরে। তবে পেঁয়াজ চাষিদের সব সময় পরামর্শ দেওয়া হয়।
কৃষিবান্ধব সরকারকার গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে জন্য বীজ, সার কৃষদের মাঝে প্রদান করেছে। সামগ্রীক কৃষির উন্নয়নের জন্য ভর্তূকি, গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বহুমুখী উদ্যোগের ফলেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ মসলা অনেক সময় সবজি হিসাবে ব্যবহার হয়। মাঝে মাঝে দেশে পেঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়, পেঁয়াজের এই উর্ধ্বগতি মূল্যে সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। অনেক পরিবার দাম বেশির জন্য পেঁয়াজ কম খায় বা খাওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সংকট রোধে শীতকালীন পেঁয়াজের পাশাপাশি গ্রীস্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে।
রাজশাহী কৃষি তথ্য সার্ভিসের এআইসিও মো. এমদাদুল হক বলেন, পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের এবং পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত ভাল। আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করে ফলন ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। আর এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করা যায় এবং বাড়তি আয়, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে প্রায় সকল মসলা ফসলের চাহিদা দেশে উৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশি। পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে মৌসুম ভিত্তিক পেঁয়াজের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে তৎপর হতে হবে।
তিনি বলেন, গ্রীস্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হলে জুলাই আগস্ট মাষে বীজ থেকে চারা তৈরি করতে হয়। এখন রাজশাহীতে কোন চাষিরা বীজ তলায় চারা তৈরি করেছে কেউ কেউ মূল জমিতে চারাগুলো রোপণ করছে। চারা রোপণের ৬০-৭০ দিন পর পেঁয়াজ উত্তোলনের উপযুক্ত হয় প্রয়োজনে ১০ দিন জমিতে বেশি রাখলে ফলন একটু বেশি হয়ে থাকে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি সংশ্লিস্ট বিভাগ তৎপর রয়েছে। এ জেলায় প্রাকৃতিক কোন দূর্যোগ না হলে এ জেলায় লক্ষ্য মাত্রা অর্জন হবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন: