[email protected] শনিবার, ২রা নভেম্বর ২০২৪, ১৭ই কার্তিক ১৪৩১

ভারী বর্ষণে হুমকিতে উত্তরাঞ্চলের কৃষি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
৭ অক্টোবার ২০২৩, ১৮:৪৯

ছবি: সংগৃহীত

টানা বৃষ্টি রেকর্ড বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে রাজশাহীর নিম্নাঞ্চল। অস্বাভাবিক এই বর্ষণ না থামলে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন চাষিরা।

বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের ধান ও সবজির আবাদ এখন হুমকির মুখে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩৫০ মিলিমিটারের কাছাকাছি বৃষ্টিতে অনেকের পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেকের ফসলি জমিতে এখনো পানি জমে আছে। এতে আমন ধান ও সবজিতে পচন ধরেছে। ভারী বৃষ্টিতে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো জানাতে পারেনি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্যগুলো মাঠ থেকে আসা শুরু হয়েছে। তাদের কর্মকর্তারাও মাঠপর্যায়ে গেছেন। আগামী রোববারের সার্বিক তথ্য পাওয়া যায়। আর জেলা মৎস্য অফিস বলছে, টানা বৃষ্টিতে পুকুর বা বিলের মধ্যে থাকা পুকুর এবং শহরাঞ্চলে থাকা পুকুরগুলো ডুবে মাছচাষিদের ক্ষতি হয়েছে। তবে উঁচু জায়গার পুকুরে তেমন ক্ষতি হয়নি। বরং কিছু এলাকায় মাছচাষিদের জন্য এই বর্ষণ ভালো হয়েছে।

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নাঞ্চলে ঘর-বাড়িতে বৃষ্টির পানি ঢুকে গেছে। মূল শহর এবং মধ্যাঞ্চলে হাঁটুপানি জমে গেছে। নগরীর সড়ক ঘেঁষে থাকা ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাশনের নোংরা পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গেছে পুরো রাজপথ। পানি নামতে না পারায় নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। পানির নিচে থাকা বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দকের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনাও। অন্যদিকে শহরের বাইরে ফসলি জমি ও পুকুরগুলো পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেছে।

পবা উপজেলার ধান চাষী হাসান আলী বলেন, গোদাগাড়ির বাংলাকান্দরে দেঢ় বিঘা জমিতে ধানের আবাদ ছিল। ধান কেবল পুষ্ট হয়েছিলো। বিগত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ধানের অর্ধেক পানির মধ্যে ডুবে গেছে। বুধবার এক-তৃতীংশ ধানের শিষ কেটে নিয়ে এসেছেন। রাতের বৃষ্টিতে বাকি ধান এখন পানির নিচে। ভারী বর্ষণ হলেও পানি আগে দ্রুত নেমে গিয়ে ফলিয়ার বিলে চলে যেত। ওই বিলজুড়ে অবৈধ পুকুর হওয়ার কারণে পানিপ্রবাহ নেই। এ কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নের কৃষক বারিউল ইসলাম। তিনি জানান, তিনি লাভজনক হওয়ায় কয়েক বছর ধরে জমি লিজ নিয়ে কপি চাষ করছেন। এবারও ১৫ কাঠা মতো কপি ছিলো। জমি উঁচু আছে। পাশে পুকুরও আছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমিতে প্লট নির্মাণ করায় পানি বের হতে পারছে না। একারণে পাশের পুকুরটিও উপচে পড়েছে। এখন জমিতে পানি। দ্রুত পানি না নামলে পুরো কপি নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। জমিতে এখনো পানি জমে আছে। ধানগাছে মুকুল হয়েছে। পানি জমে থাকলে সেগুলো পচে যাবে। পানি বের হওয়ার গতিও কম।

পবা উপজেলার সবজি চাষি মাজহারুল ইসলাম। তিনি জানান, ঋণ নিয়ে পাঁচ একর জমিতে আগাম জাতের ফুলকপি চাষ করেছেন তিনি। প্রতিটি গাছ বেড়ে উঠেছিল কিন্তু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে ফুলকপির গাছগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং নুইয়ে পড়েছে মাটির সঙ্গে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। শুধু মাজহারুল ইসলাম নয়; ভারী এই বর্ষণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাজারো কৃষক।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহীতে বর্তমানে ১ হাজার ৭৫৯ হেক্টর জমিতে বেগুন, ৯৬৩ হেক্টর জমিতে পটল, ৫৫০ হেক্টর জমিতে করলা, ৪৯ হেক্টর জমিতে কাকরোল, ১৬৯ হেক্টর জমিতে কাঁচকলা, ১৭৩ হেক্টর জমিতে বরবোটি, ৩৯২ হেক্টর জমিতে মুখিকচু, ৮৩ হেক্টর জমিতে ওলকচু, ৫০ হেক্টর জমিতে মানকচু, ধুন্দল, লতিরাজ, সজিনা, পুইশাক, ডাটা, লালশাক, পাটশাক, কলমীশাক, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙ্গা, মুলা, চিচিঙ্গা, শসা, খিরা, বাধাকপি, পেপে, পালংশাক।

এছাড়া ধনিয়াসহ খরিপ-১ এর মোট ১০ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমি ও খরিপ-২ এর ৫ হাজার ৪৪৯ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব জমি থেকে পানি নিষ্কাশণের ব্যবস্থা না থাকলে সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদরা।

রাজশাহী আবহওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বুধবার (৪ অক্টোবর) রাত ১০ টার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। সারা রাতই অব্যাহতভাবে ভারী বর্ষণ হয়। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকাল ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিলো ১৬১ মিলিমিটার। এরপর বিরতি দিয়ে দিয়ে সারাদিনই বৃষ্টি হয়। বিকেল ৪ টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ছিলো ২৪৪ মিলিমিটার। তারপরেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৩ টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ছিল -----মিলিমিটার।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক রাজিব খান জানান, আপাতত এখন পূর্বের তথ্যগুলো নেই। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা কয়েক দশকের রেকর্ড ভাঙবে। আর এখনও বৃষ্টি চলমান। সুতরাং এখনই বৃষ্টির গতিবিধি বলা যাচ্ছে না।

এদিকে, ভারী বর্ষণে রাজশাহীর অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জেলার অধিকাংশ পুকুর, ডোবা ও বিল পানিতে টইটম্বুর। অনেক জায়গায় পুকুর উপচে পড়েছে। এছাড়া তানোর, পবা, মোহনপুর, দুর্গপুরের নিম্নাঞ্চলের ধান ডুবে গেছে বলে জানা গেছে। শুধু ধান নয়, সবজির আবাদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করছেন চাষীরা।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে সে তথ্য হাতে আসে নি। তবে আশা করছি খুব বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হবে না। তবে তানোরের নিচু এলাকায় কিছু ধান তলিয়ে যাওয়ার খবর এসেছে। এরকম নিম্নাঞ্চলে যেসব আবাদ হয়েছে, সেগুলোতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর চাষীদের এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অনেকেই শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন। সেগুলোর ক্ষতি হয়েছে। তবে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে গেলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না।

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজশাহীতে এত টানা বৃষ্টি কখনো হয়নি। এতে বিলের মধ্যে থাকা পুকুর এবং শহরাঞ্চলে থাকা পুকুরগুলো ডুবে মাছচাষিদের ক্ষতি হয়েছে। তবে উঁচু জায়গার পুকুরে তেমন ক্ষতি হয়নি। বরং কিছু এলাকায় মাছচাষিদের জন্য এই বর্ষণ ভালো হয়েছে। রাজশাহীতে পানির অভাবে পুকুরে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছিল। নতুন পানি এসে মাছের উৎপাদন বেড়ে যাবে।

 

বাংলা গেজেট/এমএএইচ


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর