প্রকাশিত:
৩ অক্টোবার ২০২৩, ২০:০৩
নিশাদ আকরামের (২৪) রক্ত ‘ও-নেগেটিভ’। যেকোনো বিপদ, কিংবা রক্ত প্রয়োজন হলে মানুষের জীবন বাঁচাতে ছুটে যেতেন রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী।
কিন্তু ছিনতাইকারীরা তাকে বাঁচতে দিলো না। হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার ১৬ দিন পর মঙ্গলবার ভোরে মারা যান তিনি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে হতবিহ্বল বাবা।
শিক্ষক, সহপাঠীরাও শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তারা বলছেন, শহরের হেঁতেমখা সবজিপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ছিনতাইকারী, মাদকসেবীদের আখড়া।
নিহতের শিক্ষক, বন্ধু ও সহপাঠীরা জানান, নিশাদ আকরাম যে কারও বিপদে এগিয়ে যেতেন। নিজের ও-নেগেটিভ রক্ত দিতে চলে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। ১৫ সেপ্টেম্বর কীটনাশক পান করে অসুস্থ একজনের সেবায় সারারাত হাসপাতালে থাকেন নিশাদ।
পরদিন ভোরে বন্ধুকে নিয়ে রিকশায় করে ছাত্রাবাসে যাচ্ছিলেন। হেঁতেম খাঁ সবজিপাড়ায় দুই ছিনতাইকারী রিকশার গতিরোধ করে।
এ সময় নিশাদের কলার চেপে ধরে একজন, অপরজন মাথায় রামদার উল্টোপাশ দিয়ে আঘাত করে। এতে রাস্তায় পড়ে যান নিশাদ।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুজন ছিনতাইকারী তাদের রিকশা থামিয়ে আঘাত করলে চালক ভয়ে গতি বাড়িয়ে দেন। এ সময় নিশাদকে একজন ছিনতাইকারী ধরে রাখায় তিনি রাস্তায় পড়ে যান। দ্রুতগতিতে নিশাদের বন্ধুকে নিয়ে রিকশাটি এগিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর তার বন্ধুটি রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে নিশাদের দিকে এসে চিৎকার করতে থাকেন। স্থানীয় কয়েকজন এগিয়ে এসে তাকে হাসপাতালে পাঠায়।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিশাদের ময়নাতদন্ত হয়। এ সময় অসহায় শোকার্ত বাবা খলিলুর রহমান বাইরে সন্তানের লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটার ও-নেগেটিভ রক্ত।
এই রক্ত খুব বেশি পাওয়া যায় না। তাই খবর পেলেই মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত দিতে ছুটে যেত। গত মাসেও সিরাজগঞ্জ গিয়ে রক্ত দিয়ে এসেছে। অথচ ছিনতাইকারীরা তাকে বাঁচতে দিলো না।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা খুবই ভালো ছিল। তিনমাস পরপর রক্ত দিত। যেকোনো বিপদে ছুটে যেত। আমাকে বলত, বিসিএস ক্যাডার হব। বাবা তোমাকে ৩০ হাজার দিলেই তো চলবে? বাকিটা গ্রামের অসহায় মানুষকে দেব।
আমি বলতাম, মানুষকে এত রক্ত দাও কেন? তুমি তো অসুস্থ হয়ে যাবে। সে বলত- আমার রক্ত পাওয়া যায় না। তিন মাস পরপর রক্ত দেওয়া যায়। এতে কোনো ক্ষতি হয় না। বরং মানুষের জীবন বাঁচে।’
‘সবাইকে রক্ত দেওয়া ছেলেটা শেষ সময়ে এসে এক ব্যাগ রক্ত পেয়েছিল’ বলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন খলিলুর রহমান। বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। বড় মেয়ের ১২ বছরের ছোট ছেলে। আমি বাসের টিকিট বিক্রি করি। আয় কম।
ছেলেটাকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন। সব আশা। তাকে শেষ করে দিলো। ছিনতাইকারীরা যদি বলত, যা আছে সব দিয়ে দাও। আমার ছেলে দিয়ে দিত। তার প্রাণটা না নিলেই পারতো। এই খুনীদের শাস্তি চাই।’
নিশাদের পরিচিত ওহাব আহমেদ চঞ্চল বলেন, ‘হেঁতেমখাঁ সবজিপাড়া এলাকা মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীর আখড়া। এখানে গ্রামের ছেলেরা এসে যখন ছাত্রাবাসে উঠে তাদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা।
রাস্তায় হাঁটার সময় ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে বলে ধাক্কা দিছিস কেন? পাশে ধরে নিয়ে তখন মানিব্যাগ মোবাইল কেড়ে নেয়। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’
রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রভাষক পারভেজ রানা বলেন, ‘নিশাদ আকরাম খুবই ভালো ছাত্র ছিল। খেলাধুলা ছাড়াও নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল।
রাজশাহীকে বলা হয়, এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর। কিন্তু আমাদের কোনো নিরাপত্তা নাই এই শহরে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা না থাকলে সুন্দর শহর দিয়ে আমরা কি করব?’
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক বলেন, কলেজের সকল শিক্ষার্থী শোকাহত। আমরা এর উপযুক্ত বিচার চাই। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চাই।
বোয়ালিয়া থানার এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল আওয়াল বলেন, এই ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। সেলিম নামের একজন গ্রেপ্তার হলেও অপরজন পলাতক।
সেলিমের নামে ছিনতাই, মাদক সেবন ও বিক্রির সাতটি মামলা রয়েছে। তাকে রিমান্ডে এনে এ ঘটনায় কারা জড়িত তা বের করা হবে। ছিনতাই মামলাটি এখন হত্যা মামলায় হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে নিশাদ আকরাম রিংকুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়িতে। এ সময় তার বন্ধু, সহপাঠি ও শিক্ষকরা কলেজের দুটি বাস নিয়ে সঙ্গে যায়। বিকেলে জানাজা হবে।
বাংলা গেজেট/এফএস
মন্তব্য করুন: