প্রকাশিত:
৮ সেপ্টেম্বার ২০২৩, ০০:৪৯
বাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। ফলে গিরায় গিরায় ব্যথা, লালভাব, ফুলে যাওয়া এবং প্রদাহ হয় রোগীদের। সময়ের ফেরে বাতের ব্যথা কমে-বাড়ে। অদৃশ্য এই রোগ দুর্বিষহ করে দেয় দৈনন্দিন জীবন।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাতের চিকিৎসা বেশ দীর্ঘ। সময় সময় ব্যথানাশক কাজ করেনা। পরিবর্তি ওষুধ হিসেবে কখনো কখনো স্টেরয়েড দেন চিকিৎসক। তাতে তাৎক্ষনিক পরিত্রাণও মেলে। ফলে সল্প মেয়াদের স্টেরয়েড ইচ্ছেমত নিতে থাকেন রোগী। আর তাতেই ডেকে আনে চোখের ছানি। বাড়ে অন্ধত্বের ঝুঁকি।
সম্প্রতি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের রিউম্যাটোলজি বিভাগে চিকিৎনা নিতে আসা রোগীদের উপর গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। স্টেরয়েড ব্যবহারে অসচেনতা থেকে এই সংকট বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এনিয়ে সচেতন হবারও তাগিদ দেয়া হয়েছে।
‘বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ছানির প্রাদুর্ভাব, প্রকারভেদ এবং স্টেরয়েড যুক্ত ঝুঁকির কারণ’ ওই গবেষণাটি করেন চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর ছয়জন গবেষক। গত ২০ জুন এশিয়ান জার্নাল অফ রিসার্চ অ্যান্ড রিপোর্টস ইন অফথালমোলজিতে এই গবেষণাটি প্রকাশ হয়।
গবেষকরা বলছেন, সাধারণ বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ছানির প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধান করতে এই গবেষণা চালানো হয়। একই সাথে ছানির ধরণ নির্ধারণ, স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কাল এবং ছানির বিকাশের মধ্যে এর সম্পর্ক অনুসন্ধান করেন তারা।
তারা আরও বলছেন, বিশ্বব্যাপী অন্ধত্বের প্রধান কারণ ছানি। বাতজনিত রোগ চোখসহ জয়েন্ট, হাড়, সেরোসা এবং টিস্যুতে প্রভাব ফেলে। বাতজনিত রোগে স্টেরয়েডের ব্যবহার পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি উত্থানে অবদান রাখে। সীমিত পরেসরে গবেষণায় তারা এমনটি পেয়েছেন। আরও বড় পরিসরে অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এই গবেষণার আওতায় এসেছে রামেক হাসপাতালের রিউম্যাটলোজি বিভাগে চিকিৎসা নিতে রোগীদের রোগের ইতিহাস, স্টেরয়েড ব্যবহার এবং চোখের ছানির বিকাশ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহ চলে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত।
গবেষণার আওতায় আসেন ১১২ জন রোগী। এদেরমধ্যে ৪০ শতাংশ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং ২৫ শতাংশ সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস আক্রান্ত। অন্যরা অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস ও স্কুলাইটিসসহ বিভিন্ন বাতজনিত রোগে আক্রান্ত।
এরমধ্যে ৯০ জন মহিলা এবং ২২ জন পুরুষ। তথ্য বিশ্লেষণে ২৫ জন মহিলা এবং ১৮ জন পুরুষসহ মোট ৪৩ জনের চোখে ছানির বিস্তার পাওয়া যায়। যাদের বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। যা মোট আক্রান্তের ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার ৫ বছরের বেশী সময় ধরে চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন ৩১ জনের ছানির প্রকোপ দেখা গেছে। যা শতকরা হার ৭২ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষকরা জোর দেন, রিউমাটোলজিস্ট এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আন্তঃবিষয়ক সহযোগিতার প্রতি। বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদী স্টেরয়েড থেরাপির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের চোখের পরীক্ষারও তাগিদ দেন। বাতজনিত রোগে চোখের সম্পৃক্ততার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য গভীরভাবে অনুসন্ধানের গুরুত্বারোপ করেন গবেষকরা।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ১১২ জনের ২২৪ চোখ পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে শুষ্ক চোখ পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৪৩টি। যা শতকরা হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বাধিক ২৩টি চোখে ইউভাইটিস পাওয়া গেছে। যা শতকরা হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। নমুনার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ চোখে রেটিনোপ্যাথি পাওয়া গেছে। এছাড়া ৭ দশমিক ৩ বা ১৬ চোখে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে। রিউম্যাটোলজিক ডিসঅর্ডারগুলির সাথে সম্পর্কিত কিছু চোখের সম্পৃক্ততা প্রদর্শন করেছে।
পরীক্ষায় বাতজনিত ছানি পাওয়া গেছে ৪০ জনের, ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। ঘনত্ব অনুযায়ী সেগুলো গ্রেডিং করা হয়েছে। সবচেয়ে ঘন পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার (পিএসসি) ছানি পাওয়া গেছে ১৬ চোখে। নিউক্লিয়ার স্ক্লেরোসিস বা সাধারণ ছানি পাওয়া গেছে ১১ চোখে। ৯টি হোখে পাওয়া গেছে কর্টিকাল ক্যাটারাক্ট। মিশ্র ছানি পাওয়া গেছে ৫টি চোখে।
স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কালের ভিত্তিতে দেখা যায়, ১ বছর কিংবা তার কম সময় স্টেরয়েড ব্যবহারকারীদের পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি তৈরি হয়নি। স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কাল বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ধরণের ছানিসহ আক্রান্ত চোখের হার বেড়েছে।
১ বছর থেকে ৫ বছর স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন রোগীদের ৭৭ চোখে ছানি পাওয়া গেছে। তবে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে ৩টি চোখে। যা মোট আক্রান্তের ২ দশমিক ৭ ভাগ। ৫ থেকে ১০ বছর স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন ৫৯টি চোখে ছানি পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে ৩টি চোখে। যা মোট আক্রান্তের ৬ দশমিক ৯ ভাগ। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে স্টেরয়েড ব্যবহার করছেন এমন ৭৯টি চোখে ছানি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ১০টি চোখেই পাওয়া গেছে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি। যা মোট আক্রান্তের ১০ দশমিক ২ শতাংশ।
দীর্ঘ মেয়াদে স্টেরয়েড ব্যবহার চোখের ছানির অন্যতম কারণ বলে নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান ডা. মোঃ ইউসুফ আলী।
হাসপাতালের বর্হিবিভাগ ঘুরে চক্ষু বিভাগ (২৫ নম্বর ওয়ার্ডে এসেছেন সিদ্দিক আলী (৭৫)। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার তারাপুর এলাকার বাসিন্দা এই বৃদ্ধ চোখের ছানি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ২ সেপ্টেম্বর। বিছানা না পেয়ে তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়। সেখানেই কথা হয় এই রোগীর সাথে।
তিনি বলেন, প্রায় একযুগ ধরে বাতের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। এলাকায় বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ওষুধ খেয়েছেন, কিন্তু বাতের ব্যথা নিরাময় হয়নি। ওষুধ খেতে খেতে এক পর্যায়ে চোখে কম দেখতে শুরু করেন। রামেক হাসপাতালে এসে জানতে পারেন, ডান চোখে ছানি পড়েছে।
চোখের ছানি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জেলার বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আকরাম আলী প্রামানিক (৬৫)। তিনি জানান,একসময় তিনি হাডুডু-ফুটবল খেলতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে আঘাতজনিত কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তার চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করে। চিকিৎসায় ছানি ধরা পড়ে। অপারেশন না করলে পরিত্রাণ নেই।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রিম্যাটলোজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. আসিফ হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসারে স্টেরয়েড ৩ মাসের বেশি ব্যবহার করা যায়না। এটি মূলত: সাময়িক ওষুধ। নিয়মিত ওষুধে কাজ না করলে স্টেরওয়েড দেয়া হয়।
এটি দ্রুত ব্যথা নিরাময় করে। ব্যথানাশকও খেতে হয় না। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন কোন ওষুধের কি কাজ এবং কত দিন সেবন করতে হবে সেটি রোগীদের জানিয়ে দেয়া। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক সেটি করেননা। তাছাড়া ওষুধ বিক্রেতা বা হাতুড়ে চিকিৎসকের কথামতো দীর্ঘদিন স্টেরয়েড সেবন করে থাকেন রোগী। সঙ্গতকারণেই রোগী অসেচতনভাবে এটি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড গ্রহণ শরীরে স্বাভাবিক স্টেরয়েড হরমোনের নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে। একটা সময় রোগী স্টেরয়েড ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হাড়ক্ষয়, মাংসপেশির দুর্বলতা এবং চোখের ছানি দেখা দেয়। কমে যায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। এনিয়ে সচেতনতা জরুরী।
মন্তব্য করুন: