[email protected] শুক্রবার, ১লা নভেম্বর ২০২৪, ১৭ই কার্তিক ১৪৩১

স্বতন্ত্র আতঙ্কে নৌকা

জাতীয় ডেস্ক

প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বার ২০২৩, ১০:১৩

ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর আতঙ্কে নৌকার প্রার্থীরা। আগে থেকেই দলীয় হাইকমান্ডের সতর্কবার্তা ছিল, ‘নৌকা পেলেই বিজয় নিশ্চিত– এ ধারণা পাল্টাতে হবে। উৎসবমুখর নির্বাচনে জয়ী হতে হবে।’ খবর সমকাল।

সমকাল জনাচ্ছে, এই বার্তায় উৎসাহিত হয়ে মনোনয়নবঞ্চিত ১২ এমপিসহ ৫৮ আওয়ামী লীগ নেতা এরই মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তাই নৌকা পেয়েও বিজয় নিশ্চিত করতে ‘প্রশাসনিক সুবিধার’ আশায় রয়েছেন– এমন প্রার্থীরা শঙ্কায় পড়েছেন।

অনেক আসনে মনোনয়নবঞ্চিতরা ঘোষণা না দিলেও নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ার প্রস্তুতির খবর মিলেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা থাকবে না ইঙ্গিত দিয়ে দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সব আসনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে কঠোর হবে না আওয়ামী লীগ। 

তাঁর এ ঘোষণায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত হচ্ছেন আওয়ামী লীগের পদধারী অনেকে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন লাগে। বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহে মাঠে নেমেছেন অনেকেই। বিভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার খবর মিলেছে। তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে পদত্যাগ করছেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা সমকালকে বলেন, মনোনয়ন পেয়েও অনেকেই জয়ের ব্যাপারে অনিশ্চিত। এর আগের দু’বার এমপি হয়েছেন প্রশাসনিক সহায়তায়। এসব আসনে প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে দল কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছেন। 

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে নৌকা পেলেই বিজয় নিশ্চিত– এ ধারণা তৈরি হয়েছিল। প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে কোণঠাসা করে ভোটের মাঠ ফাঁকা করার কৌশল এবার হয়তো কাজে আসবে না। আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে আন্তর্জাতিক শক্তির তাগিদ ও নজরদারি রয়েছে।

বিএনপি বর্জন করলেও সরকার ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া ঠেকাতে বিকল্প (ডামি) প্রার্থী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ প্রয়োগ না করতে দলের প্রার্থীদের নির্দেশ দিয়েছেন।

ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রাখতে জোটগত অবস্থানের বিষয়টিও পরিষ্কার করা হয়নি। গতকাল সোমবার ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘কার সঙ্গে কী সমঝোতা হবে, কাকে কত আসন দেব, কীভাবে জোট করব, জোটটা নির্বাচনের স্বার্থে কোন পথে সুবিধাজনক– এসব অনেক কিছু নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম জমা ও প্রত্যাহারের এখনও সময় আছে।’

তপশিল অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। নৌকা প্রতীক নিশ্চিত করতে এর আগেই দলীয়প্রধানের সই করা চিঠি নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের সবাই প্রতীক বরাদ্দের চিঠি পাবেন এর নিশ্চয়তা নেই। কারণ জোটের শরিকদের জন্য আওয়ামী লীগ কোন আসন এবং কতটি আসন ফাঁকা রাখবে তা নিশ্চিত নয়। 

বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। এর পুনরাবৃত্তি চায় না আওয়ামী লীগ। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়। নৌকা পেতে ৩ হাজার ৩৫৬টি আবেদন ফরম কেনা নেতাদের কাজে লাগাতে চায় দলটি। এই বার্তায় নৌকা বঞ্চিতরা নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহী হয়েছেন। 

কক্সবাজার-১ আসনের এমপি জাফর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি জনবিচ্ছিন্ন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, এমপি হয়ে জাফর আলম ত্যাগী নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা এবং বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।

পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি মজাহারুল হক প্রধানকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাইমুজ্জামান ভূঁইয়াকে। মজাহারুল হক বলেন, দল ভালো মনে করায় তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে জনগণ তা মানবে না। ১০ বছরে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন দাবি করে মজাহারুল হক প্রধান জানান, জনপ্রিয়তা যাচাই করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন।

ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এ. কে. আজাদ। সোমবার রাতে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলীর বাসভবনে দলের নেতাকর্মীর এক সভায় তিনি বলেন, ফরিদপুর অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উন্নয়নের ধারার সূচনা করেছেন, তা অব্যাহত রাখতে ও সমর্থকদের কথা বিবেচনা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চাই। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়াতে চাই।

নওগাঁ-৩ আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন সেলিম মনোনয়ন পাননি। তাঁর ভাগনে শাকিল তরফদার বলেন, ছলিম উদ্দিন মঙ্গলবার (আজ) স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।

সিলেট-৬ বিয়ানীবাজার আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সরওয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, ১৫ বছর ধরে দুই উপজেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশে আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মেনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করব।

কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এমপি এম এ মতিনকে সরিয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সৌমেন্দ্র প্রসাদ পাণ্ডে (গবা)। এম এ মতিনের বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখার কাজ ঠিকমতো না করাসহ নদী দখলের অভিযোগ রয়েছে। হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়ে মতিন বলেন, ‘এখন দল যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বলে, তাহলে নির্বাচন করব। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নয়।’

গাইবান্ধা-৪-এর এমপি মনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। মনোনয়ন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মনোয়ার বলেন, ২৬ নভেম্বর মনোনয়নের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার কথা। কিন্তু ২৭ নভেম্বর প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়। এতে আবুল কালাম আজাদের নাম এসেছে। এক দিন পেছানোয় আবুল কালাম অর্থের বিনিময়ে তা করিয়েছেন।

রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে পঞ্চমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীর বহু অভিযোগ রয়েছে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও মুন্ডুমালা পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম রাব্বানী।

তিনি বলেন, ‘দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। তাই ভোট করলে দলের বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। বরং সরকার চাইছে, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হোক। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাই। এটা বিদ্রোহ না, বরং ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে এনে সরকারকে সহযোগিতা করা।’ এই আসনে জেলার আরেক নেতা আখতারুজ্জামান আখতারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

রাজশাহী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে তিনবারের এমপি এনামুল হক ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

রাজশাহী-৫ আসনে দু’বারের এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা ২০১৮ সালে মনোনয়নবঞ্চিত হন। এবার পেয়েছেন। এই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান। জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রার্থিতা ওপেন করে দিয়েছেন। এ কারণে ভোটের উৎসব ফেরাতে প্রার্থী হবো।

রাজশাহী-৬ আসনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম চতুর্থবার মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দলের বড় অংশ অনেক দিন ধরে সক্রিয়। স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন জানিয়ে এই আসনের সাবেক এমপি রায়হানুল হক বলেন, ‘দলের একটি বড় অংশ আমার সঙ্গে।’

সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১৫ বছর এমপি ছিলাম। নেতাকর্মীকে জানিয়ে দিয়েছি, বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেব। এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীর কাছে হাওরবাসীকে তুলে দেব না।’

এ আসনের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেলিম আহমদও নির্বাচন করার কথা জানিয়েছেন। সেলিম বলেন, ‘সমর্থকদের চাপে আছি। এ জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছি।’ সাবেক সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার ভানুও গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান নির্বাচন করবেন বলে অনুসারীরা জানিয়েছেন। তিনি সমকালকে বললেন, কর্মী-সমর্থকরা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন, তাদের চাপেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমনও মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তাঁর দাবি, তৃণমূলের চাপে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেন।

সব মিলিয়ে ৫৫টি আসনে আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার খবর মিলেছে।

বাংলা গেজেট/এফএস


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর