প্রকাশিত:
২৭ নভেম্বার ২০২৩, ০৯:১০
বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা বিরোধী রাজনৈতিক দলের চলমান আন্দোলনের তথ্য চলে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীই পুলিশের সোর্স হিসাবে কাজ করছেন। খবর যুগান্তর।
যুগান্তর জানাচ্ছে, নেতাকর্মীদের নিজেদের মধ্যকার ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডও পেয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণে নেতাকর্মীদের অনেকেই উৎসাহী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করছেন। অনেকে আবার গ্রেফতার এড়াতে এমন কাজ করছেন।
আগাম তথ্য পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে-এমন দাবি পুলিশের।
এছাড়া হরতাল-অবরোধে শান্তিপূর্ণ মিছিল করতেও বেগ পেতে হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগেই গ্রেফতার হচ্ছেন অনেকে।
এদিকে নেতাকর্মীদের অনেকেই পুলিশের সোর্স হিসাবে কাজ করছেন-এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন বিএনপির শীর্ষ কর্তারা। তারা বলছেন, ‘এসব সরকারের সাজানো নাটক। আগুন-সন্ত্রাসের পেছনে সরকার সমর্থকরা জড়িত।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে দলটির ৪ হাজার ৬১০ জনের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। মামলা হয়েছে ১৫৩টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৭ হাজার ৮৩০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপের গ্রুপে তথ্য আদান-প্রদান করছেন আন্দোলনকারীরা। সেখানেই নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের শিফট পরিবর্তনের সময়কে অগ্নিসংযোগের নিরাপদ সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে।
মেসেঞ্জার গ্রুপে থাকা কেউ কেউ ওইসব মেসেজ স্ক্রিনশট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও ফোনের কথোপকথনের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সরবরাহ করছে। ফলে আগে থেকেই ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকছে। এতে সহিংসতা অনেকাংশে রোধ করা যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ আগাম তথ্য পাওয়ায় নাশকতা অনেকাংশে কমে এসেছে। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে অগ্নিসংযোগ করতে চাচ্ছে না। টাকা দিয়েও মাঠের কর্মীদের আন্দোলন, নাশকতায় নামাতে পারছে না বিএনপি-জামায়াত।’
তারা আরও বলেন, ‘ফোনে যে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছে অগ্নিসংযোগকারীরা, তাও আমারা জানতে পেরেছি।’
পুলিশের পাওয়া কিছু তথ্য যুগান্তরের কাছে এসেছে। এনক্রিপটেড অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপের একটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, সোমবার সকালে রাজধানীর ওয়ারী এলাকার এক নেতা লিখেছেন, ‘কালকে থানা ও কলেজ এলাকায় আলাদা মিছিল করবে। ১০ থেকে ১৫ জন, যেই কয়জনই হয়, করতে হবে মিছিল। না পারলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের ওই নেতা বুধবার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আরও লিখেন, ‘তোমাদের বলা হইছিল আলাদা মিছিল করতে? আজকে কেউ একটা মিছিল করলে না। অথচ সবাই পদ নিয়ে বসে আছ। মিছিল করতে না পারলে পদ ছেরে দাও সবাই।’
একই গ্রুপে লেখা হয়েছে, ‘সবাই প্রস্তুতি নিয়ে রাখবা মশাল মিছিলের। সেফ জায়গা পেলে অবশ্যই আমরা মিছিল করব ৬/৭টায়। চেষ্টা করবা লোকজন নিয়ে আসতে। কাল সকালে সবাই লোকজন বাড়িয়ে আনবে। আমরা ৬/৭টার মধ্যে মিছিল করে ফেলব। ওই সময় পুলিশের উপস্থিতি কম থাকে। আমি লোকেশন একটু পরে জানিয়ে দিচ্ছি।’
পুলিশকে পাঠানো এক মেসেজে বলা হয়েছে, ‘কমলাপুর মাঠের রাস্তা থেকে খোকা কমিউনিটি সেন্টারের দিকে সকাল ৭.৩০-এর মধ্যে মিছিল হবে। ১০০% শিউর।’
২২ নভেম্বর পুলিশের মিরপুর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি নাশকতার মেসেজ পান। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ায় অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে পেরেছে পুলিশ।
ওই মেসেজে বলা হয়, ‘২২/১১/২০২৩ তারিখ ২২:৩১ ঘটিকায় ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান টিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাবুর (০১৬২১৮০৯৯২৫) সঙ্গে আবুল হাসান টিপুর অপর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুমনের (০১৭৫৯০৬৬৮১৫) আলোচনা হয়।
ওই সময় বাবু বলেন, বিএনপি ঘোষিত অবরোধকে সফল করার লক্ষ্যে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করার জন্য আমাকে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান টিপু ভাই খরচ দিতে অদ্য ২৩/১১/২০২৩ তারিখ ১২টার পর তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।’
আলোচনাকালে বাবু আরও বলেন, ‘আজকে আমাদের ভালোই প্রস্তুতি ছিল। তবে পুলিশের তৎপরতার কারণে কাজটা করতে পারিনি। যেখানেই গেছি, পুলিশ সেখানেই উপস্থিত হয়।’
সুমন বলেন, ‘যে কোনোভাবেই হোক একটা কাজ (গাড়িতে অগ্নিসংযোগ) সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে তো ভালো পোস্ট পজিশন পাওয়া যাবে না। দুই-একদিনের মধ্যেই সফলভাবে একটা কাজ (গাড়িতে অগ্নিসংযোগ) করব। পুলিশকে এড়িয়ে কাজটা করতে প্ল্যান করতে হবে।’
প্ল্যানের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের ওপর নজর রাখতে একজন টেকনিক্যাল মোড়ে থাকবে, একজন কল্যাণপুর এবং একজন হাউজিংয়ের ভেতরে থাকবে। বাবু একজনকে নিয়ে বাইকে গাবতলী ব্রিজের দিকে থাকবে।
সুমন কয়েকজনকে নিয়ে ব্রিজের আশেপাশে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করবে। কোনো লোকজন এলে লাঠি দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করবে। যদি এবারও পুলিশের তৎপরতায় কাজ করতে না পারি তাহলে কয়েকজন ভবঘুরে (নেশাগ্রস্ত যুবক) দিয়ে কাজটা করানো হবে।’
এই কথোপকথনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে রোববার বিকালে সুমনকে ফোন করলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘হ্যাঁ, বাবুর সঙ্গে এমন কথা হয়েছে।’
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু যুগান্তরকে বলেন, এসব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাজানো নাটক। সরকার বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে ভুয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আইডি খুলে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়ায়।
বিএনপির চলমান আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে এসব করছে সংস্থাগুলো। এমনকি দলের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যার হুমকি দিয়ে সংস্থার উপস্থাপন করা বক্তব্য দিতে বাধ্য করায়, যা পরবর্তী পর্যায়ে কোর্টে মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘসময় ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন, খুন-গুম-হত্যার শিকার নেতাকর্মীরা দলের কোনো সিদ্ধান্ত কখনোই কোনোভাবে অন্যদের কাছে পাঠান না। এসবের সঙ্গে প্রকৃত নেতাকর্মীরা জড়িত নন।
বাংলা গেজেট/এফএস
মন্তব্য করুন: