প্রকাশিত:
৩ নভেম্বার ২০২৩, ১৪:৪৮
আজ থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৭ সালের দিকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে একটি জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’। আলুর পর্যাপ্ত চাষ ও দাম কম থাকায় সরকারিভাবে পোস্টার ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই শ্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে সেই আলু হয়ে গেছে এখন বিলাসী পণ্যের মতো। বাজারে হু-হু করে বেড়েছে আলুর দাম। প্রতি কেজি আলু কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে। একটু বড় সাইজের এক পিস আলুর দাম পড়ে যাচ্ছে প্রায় ৮-১০ টাকা। যে টাকায় তৎকালীন সময় গ্রামে-গঞ্জে দুই কেজি আলু পাওয়া যেত।
বর্তমানে এক কেজি আলুর দামের টাকা দিয়ে ২০০১ সালে পাওয়া যেত প্রায় এক কেজি গরু মাংস। ওই সময় এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া যেত ৮০ টাকায়। কয়েক বছর আগেও মৌসুমের সময় আলুর দাম প্রতি কেজি ৭-৮ টাকা পেয়েছে কৃষক। চলতি বছরেও আলুর মৌসুমে ১২-১৫ আলু বিক্রি করেছেন অধিকাংশ কৃষক। কিন্তু বর্তমানে সেই আলু ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে ২০০১ সালে হলেন্ডের আলুর গড় দাম ছিল গড় দাম ছিল ৮.৫৮ টাকা। ২০০৫ সালেও গড় দাম ছিল ৮.৭০ টাকা। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ১৫.২৯ টাকা। এরপর ২০১৫ সালে গড় দাম ছিল ২৪.৫৮ টাকা। তার পাঁচ বছর পরে ২০২০ সালে তার দাম দাঁড়ায় ৩৬.৬৩ টাকা। এই পাঁচ বছরের অন্তর-অন্তরের মাঝের বছরগুলোতে কিছুটা উঠা-নামা করে আলুর দাম। মৌসুমের প্রথম নতুন আলুর দাম অনেক বেশি হলেও পুরাতন আলু স্বাভাবিক দামেই বিক্রি হয়ে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের ওপর তেমন চাপ পড়ে না। কিন্তু বর্তমানে গত ৩১ অক্টোবরের (বুধবার) তথ্য অনুযায়ী, পুরাতন আলু বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা কেজি।
প্রতি কেজি আলু কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে এক কেজি আলুর দামের টাকা দিয়ে ২০০১ সালে পাওয়া যেত প্রায় এক কেজি গরু মাংস। ওই সময় এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া যেত ৮০ টাকায়।
জানা গেছে, বর্তমানের হিমাগারগুলোতে যা আলু আছে বেশিরভাগই ব্যবসায়ীদের। ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে চাষিরা জমি থেকে বিক্রি করেছেন ১০-১৫ টাকা কেজি। যা প্রতি কেজি উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ পড়ে ৮-১০ টাকা। কৃষক শুধু বীজের জন্য সামান্য আলু হিমাগারে রাখেন। গত মার্চে ব্যবসায়ীরা ৫০ কেজির বস্তায় ভরে আলু হিমাগারে রেখেছেন। বস্তা খরচ, হিমাগার ভাড়া, শ্রমিকসহ পরিবহন খরচ সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের খরচ হয়েছে ২২-২৩ টাকার মতো। সেই আলু খুচরা বিক্রেতারা কিনছেন ৫৪-৫৬ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ যেই আলু কৃষক ১৫ টাকায় বিক্রি করেছেন বর্তমানে সেই আলু গ্রাহকদের কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়।
এ বিষয়ে উত্তরের জেলা দিনাজপুরের হোসাইন নামে এক প্রান্তিক কৃষক বলেন, কয়েক বছর ধরেই লসে আলু বিক্রি করি। ৮-১০ টাকাতেও কেউ কিনছিল না তখন। এই বছর ১২-১৪ টাকা কেজি আলু বিক্রি করেছিলাম। এখন সেই আলুর দাম ৬০ টাকার উপরে। কয়েক মাস খাটা-খাটনি, পরিশ্রম করে আমরা আলু আবাদ করি। পানির দামে বেচে দেই। আর ব্যবসায়ীরা কোনো শ্রম না দিয়ে কয়েকগুণ লাভ করতেছে। এই দুঃখ কার কাছে বলি।
ঠাকুরগাঁও এলাকার আরেক আলু চাষী জাহাঙ্গির বলেন, কয়েক বছরের তুলনায় এবার একটু ভালো দাম পেয়েছিলাম। ১৫-১৬ টাকায় আলু বিক্রি করেছি। কিছু রাখছিলাম বিজের জন্য। কিন্তু এখন যে অবস্থা দেখতেছি তাতে আমাদের আফসোস করা ছাড়া আমাদের কৃষকদের আর কিছুই নাই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টন। অপরদিকে দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আলু চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনের পরেও কেন আলুর এত বেশি দাম।
গত সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক অভিযোগ করেছেন, কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা একটি সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে। কোনোভাবেই আলুর কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকার বেশি হতে পারে না। দেশে আলুর উৎপাদন বেড়েছে প্রচুর। আমরা বলি, আলু উদ্বৃত্ত থাকে। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও উন্নত জাত প্রবর্তনের কারণে উৎপাদন বেড়েছে। আবহাওয়া আলু উৎপাদনের অনুকূল।
দফায় দফা দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর জরুরি তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে ২৬-২৭ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা মূল্যে বিক্রয়ের জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপর থেকেই সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে মাঠে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। কিন্তু তারপরেও কিছুতেই কার্যকর হয় না সেই দাম।
পরবর্তীতে সোমবার (৩০ অক্টোবর) দেশে আলুর উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক দামে বাজারে বিক্রয় হওয়ায় আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ১ লাখ ৭ হাজার টন আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
যেখানে দেশেই চাহিদার থেকে অনেক বেশি আলু রফতানি হয় সেখানে অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে না পেরে আলু করাটা লাজ্জাজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কাছে টিকতে না পেরে সরকার শেষপর্যন্ত আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি নাজের হোসেইন বলেন, দেশে এত আলু চাষ হওয়ার পরেও তা আমদানি করাটা বেদনাদায়ক। এতে চলমান ডলার সংকট আরও বাড়বে। কিন্তু আমদানি না করেও তো উপায় নেই। তা ছাড়া তো সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এখনও আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আলু মজুদ আছে।
তিনি আরও বলেন, আবার আলু আমদানি কারা করবে? যারা সিন্ডিকেট করছে তারাই তো করবে। সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ডিম এসেছে। এখন দেখার বিষয় কবে আলু আমদানি করা হয় আর কবে বাজারে আসে। দামই বা কত হয়।
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: