প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বার ২০২৩, ১৪:২০
‘আগে যেখানে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন মুরগির মাংস খেতাম, এখন সেখানে একদিন খেতে হচ্ছে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে চারদিন সবজি খাচ্ছি, দু’দিন ডিম বা মাছ। দুই একদিন মাছ, মুরগি থাকলেও তা আকারে অনেক ছোট হয়ে গেছে। পুষ্টির চাহিদা মেটানো দূরে থাক, কোনোভাবে খেয়ে বেঁচে আছি এটাই অনেক।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে কথাগুলো বলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রহিম নামের এক শিক্ষার্থী। শুধু আব্দুর রহিমই নন, এমন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন পড়াশোনা কিংবা চাকরির খোঁজে ঢাকায় থাকা ব্যাচেলরেরা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ব্যাচেলরদের খাবারের মান কমে খরচ বেড়েছে। খাবারের তালিকা থেকে গরুর মাংস বাদ পড়েছে অনেক আগেই। মাছ থাকলেও সেটি আকারে ছোট হয়ে এসেছে। স্বল্প খরচে আগে যারা আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উপর নির্ভর করতেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন এটিও তাদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।
পড়াশোনা কিংবা চাকরি উদ্দেশ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনেকেই মেসে এবং হোস্টেলে থাকেন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তাদের খাবারের খরচ বেড়েছে। চাহিদামতো খাবার খেতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
৪ মাস আগে মাস্টার্স শেষ করে চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন আমিনুর রহমান। একত্রে থাকলে খরচ কম হবে বিধায় ব্যাচেলর মেসে উঠেন তিনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এসময়ে বেড়েছে বাসা ভাড়াও। ঢাকায় বসবাস করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
আমিনুর রহমান জানান, ‘অধিকাংশ চাকরির পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে এসব পরীক্ষা দিতে অনেক খরচ হয়ে যায়। তাই চাকরির পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য ঢাকায় ব্যাচেলর বাসায় সিট ভাড়া করে থাকি। প্রতিমাসে খরচ বাবদ পরিবার থেকে ৬-৭ হাজার টাকা পাঠায়। এ টাকায় চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করা, সিট ভাড়া আর খাবার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এইদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ফলে সংসার চালানো বাবার পক্ষেও কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় পরিবার থেকে আগের মতো টাকা চাইতে পারছি না। এক দুই মাসের মধ্যেই হয়তো আবার গ্রামে ফিরে যেতে হবে।’
সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চাকরি প্রত্যাশি হাবিবুর রহমান জানান, ‘মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের খাদ্য তালিকায় প্রধান খাবারই ছিল মাছ, মুরগি এবং ডিম। এখন সব কিছুরই দাম বেড়ে গেছে। বাড়ি থেকে কিংবা টিউশন করিয়ে আগে যে টাকা পেতাম এখনো তেমনই পাচ্ছি। ফলে আগে যেখানে সপ্তাহে ২ দিন মুরগি, ২ দিন মাছ, ২দিন ডিম ও ১ দিন সবজি খেতাম, এখন সেখানে সপ্তাহে ১ দিন মাছ, ১ দিন মুরগি, ১দিন ডিম ও বাকি ৪ দিন সবজি খেতে হচ্ছে।’
মেসের খাদ্য তালিকায় আমিষ জাতীয় খাবারের পরিমাণ কেমন থাকে? এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থী নাজমুল আলম জানান, ‘দাম বেশির কারণে অনেক আগে থেকেই খাসির মাংস খাওয়া হয় না। মাসে দুই তিন দিন গরুর মাংশ খাওয়া হলেও দাম বেশির কারণে এখন সেটাও বাদ দিতে হয়েছে। এখন মাসে চার-পাঁচ দিন মুরগি, চার-পাঁচ দিন মাছ, ডিম এবং বাকি দিনগুলাতে সবজি খাচ্ছি।’
যাত্রাবাড়ি এলাকা মেসে থাকেন শিক্ষার্থী ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমিত টাকায় ঢাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে উঠেছে। আগে মাঝেমধ্যে দুই একটা জামা, গেঞ্জি কিনতাম, এখন তিনবেলার খাবার খেতেই কষ্ট হচ্ছে।’
ব্যাচেলরদের আমিষের ঘাটতি পূরণে ডিম, মুরগির মাংশ, ডাল এবং মাছই যেখানে ভরসা ছিল, এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় আমিষ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগার আশঙ্কা করছেন তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ব্রয়রার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায়, এক হালি ব্রয়লার মুরগির ডিম কিনতে গুণতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা। ৭০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের রুই, মৃগেল মাছ কিনতে লাগছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। প্রতি কেজি মসুর ডাল ৯০ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়া বাজারে আলু, পটোল, ফুলকপি এবং কাঁচা পেঁপে ছাড়া ৬০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যাচেলদের পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামিমুল ইসলাম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সব ধরনের শ্রেণি-পেশার মানুষই বিপাকে পড়েছেন। সবচেয়ে সংকটে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে এবং মেসে থাকা ব্যাচেলরদের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। সংকট সমাধানে ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্য আমদানির জন্য অনুমতি দিয়েছে সরকার। এছাড়াও টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে।’
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: