[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ ১৪৩১

বদলে যাওয়া জলবায়ুতে বরেন্দ্র কৃষি

ভরসা এখন খরা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
৯ আগষ্ট ২০২৩, ০৬:৩১

বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমন খেত ফেটে চৌচির। খেত বাঁচাতে কৃষক গভীর নলকূপের পানি তুলছেন।

ভরা বর্ষায় খরায় ধুঁকছে বরেন্দ্র অঞ্চল। বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমন খেত ফেটে চৌচির। খেত বাঁচাতে কৃষক গভীর নলকূপের পানি তুলছেন। পানি নিবিড় ধান চাষে চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির উপর। দীর্ঘদিন ধরে পানি উত্তোলনে নামছে পানির স্তর। বাড়ছে পরিবেশগত সংকট।

এরই মধ্যে বরেন্দ্র খ্যাত রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়নকে 'অতি উচ্চ' ও 'উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে চিহ্নিত করেছে ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন (ওয়ারপো)।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ওয়ারপো দেখিয়েছে, বরেন্দ্রের এই তিন জেলার ৪০টি ইউনিয়ন 'উচ্চ পানি সংকটাপন্ন' ও ৬৫টি ইউনিয়ন 'মাঝারি পানি সংকটাপন্ন'। এই অঞ্চলে ২৮টি ইউনিয়ন 'কম পানি সংকটাপন্ন' ও ৩৪টি 'খুব কম কম পানি সংকটাপন্ন' এলাকা।

ওয়ারপো বলছে, সেচের জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে এই সংকট। কিছুটা দায়ি জলবায়ু পরিবর্তনও। এই পরিস্থিতিতে পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পানি-নিবিড় বোরো ফসলের বিকল্প হিসেবে কম পানি ব্যবহার করা হয় এমন ফসলের চাষ উৎসাহিত করার সুপারিশ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এই পরিস্থিতিতে বরেন্দ্র কৃষকদের খরা মানিয়ে নিয়ে চাষাবাদের পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি খরা প্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা ব্যবস্থাপনা কৌশল নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে এই গবেষণা শেষ হয় চলতি বছরের মার্চে। এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল উপযুক্ত খরা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বৃদ্ধি। তাতে আর্থিক সহায়তা দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়।

গবেষণা প্রধান ছিলেন গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজশাহী অঞ্চলের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ইলিয়াছ হোসেন। তার সহযোগী ছিলেন গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন। গত ৩১ মার্চ তারা গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এই দুই কৃষি বিজ্ঞানী বলছেন, রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের খরাপ্রবণ এলাকা। খরিফ ১ মৌসুমের (চৈত্র মাস থেকে আষাঢ় মাস অর্থাৎ ১৬ মার্চ হতে ১৫ জুলাই পর্যন্ত) প্রায় ৩ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমি পতিত থাকে। এই মৌসুমে বোরো ধান চাষ করেন। এক কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় ৫ হাজার লিটার পানি খরচ হয়। পানি সাশ্রয়য়ে বোরো ধানের পরিবর্তে গম, ভুট্টা, মুগ, মসুর, তিল, আউশ ধান, মাশকালাই চাষ করা যায়।

আবার অধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ক্রমাগত ধান চাষে মাটির উর্বরতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শষ্য বিন্যাসে ডাল ও তেলবীজ অন্তর্ভুক্তি এবং অজৈব সার প্রয়োগ ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। তারা আরও বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে আয় বাড়বে কৃষকের। উৎপাদন খরচা কমিয়ে ফসলের ভালো বাজারমূল্য নিশ্চিত করলে বদলে যাবে কৃষকের ভাগ্য।

এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল খরাপ্রবণ এলাকায় রবি মৌসুমে নতুন জাতের ডাল, তেলবীজ, গম এবং অন্যান্য উচ্চভূমির ফসলের প্রবর্তনের মাধ্যমে ফসলের নীবিড়তা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। মাটি, পানি, জ্বালানি, শ্রম, জীববৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ হবে এই কৌশলে। খরা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদনে আরও প্রায় ১০-১৫ হাজার টন বিভিন্ন ফসলের ফলন যুক্ত হবে।

গবেষণায় তারা দেখতে পান, খরা ব্যবস্থাপনা কৌশলে শস্যের নিবীড়তা ১২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন খরচ কমেছে প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ। কৃষকদের আয় প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সেচের পানি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ হয়েছে। সবমিলিয়ে খরাপ্রবণ এলাকায় কৃষকদের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছে।

কৃষি বিজ্ঞানী ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, আমরা পুরানো জাতের পরিবর্তে বারি গম-৩০, বারি গম-৩২ এবং বারি গম-৩৩ জাতগুলো চাষাবাদ ছড়িয়ে দিয়েছি। জাতগুলো খরা সহিষ্ণু ও ব্লাস্ট প্রতিরোধী। একই ভাবে জিংক ও আয়রন সমৃদ্ধ বারি মুশুর-৮ ও বারি মুশুর-৯ আনা হয়েছে চাষের আওতায়। তাপ ও খরা সহনশীল এবং জিং ও আয়রন সমৃদ্ধ জাতের ভুট্টা চাষ হয়েছে। এছাড়া খরা ও তাপসহনীয় এবং জিংক ও আয়রন সমৃদ্ধ ব্রি ধান-৭১ এবং ব্রি ধান-৭৫ চাষ হয়েছে। কঠিন পরিস্থিতিতেও ভালো ফলন পেয়েছেন চাষি।

তিনি আরও বলেন, খরা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিতে প্রচলিত শষ্য বিন্যাস থেকে পানি নিবীড় বোরো ধান বাদ দিতে হবে। আমন ধান কেটে নেয়ার পর গম চাষ করতে হবে। গম তোলার পর একই জমিতে মুগডাল চাষ হবে। শষ্য বিন্যাসে গমের পরিবর্তে ভুট্ট চাষ করা যেতে পারে। এই দুটি শষ্য বিন্যাস পানি সাশ্র্রিয়। তাছাড়া ব্যয় ও সেচ সাশ্রয়ি শূণ্য চাষ কিংবা বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে জমি চাষ করতে হবে। ততে সবদিক দিয়েই কৃষকের লাখ। সুরক্ষিত থাকবে পরিবেশও।

অন্যদিকে, আরেক গবেষক জাকির হোসেন জানান, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলায় কৃষকদের মধ্যে মোট ১২০ প্লটে পরীক্ষা চালানো হয়। মূলত: প্রচলিত চাষ পদ্ধতির সাথে বেডপ্লান্টিং, শূন্য চাষ বা রিলে পদ্ধতিতে ধান, মসুর, সরিষা, ভুট্টা এবং গম চাষ করা হয়েছে।

আমরা ধানের পতিত ফসলের প্যাটার্নের জন্য মসুর এবং গম অন্তর্ভুক্ত করেছি। এতে ফসলের তীব্রতা প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে উৎপাদন খরচ কমেছে প্রায় ৪৫-৮০ শতাংশ কমেছে। সেচের পানি সাশ্রয় হয়েছে ৩০ থেকে ৩০ শতাংশ। ইঁদুরেরে আক্রমণ কমেছে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ।

এই কৌশলে জুলাইয়ের গোড়ার দিকে আমন হিসেবে ব্রি ধান-৭৫ রোপন করা হয়। এই ধানের গড় জীবনকাল ১১০ থেকে ১১৫ দিন। ধান কাটার ঠিক আগে-পরে মাটিতে রস থাকা অবস্থায় রিলে কিংবা জিরো চাষ পদ্ধতিতে ডাল এবং মটর বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়।

আবার আমনের জাত হিসেবে ব্রি ধান-৭১ আবাদ করা হয় কিছু খেতে। উচ্চফলনশীল ধানের এই জাতটির গড় জীবনকাল ১০৬ দিন। এটি একটি খরা সহনশীল জাত। প্রজনন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২১ থেকে ২৮ দিন বৃষ্টি না হলেও ফলনের তেমন ক্ষতি হয় না।ধান কেটে নেয়ার পর কিছু জমিতে বেড পদ্ধতিতে বারি গম-৩০ এবং বারি গম-৩৩ চাষ করা হয়। গম কেটে নেয়ার পর মুগডাল চাষ করা যায়।

জাকির হোসেন আরও বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রতি ১৫ বর্গমিটারে ধানে ৭২০ লিটার, গম চাষে ৩২০ লিটার এবং মুগডাল চাষে ১৫৫ লিটার সেচের পানি খরচ হয়। একই পরিমাণ জমিতে বেড পদ্ধতিতে ধান চাষে ৫৫০ লিটার,  গম চাষে ২৪০ লিটার এবং মুগডাল চাষে ১১০ লিটর সেচের পানি খরচ হয়। এক্ষেত্রে পানি সাশ্রয় ধানে ২৩ শতাংশ, গমে ২৫ শতাংশ এবং মুগডালে ২৯ শতাংশ।

অন্যদিকে, সার ও বীজ বাদে প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান চাষের বিঘায় খরচ হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা, গম চাষে ১ হাজার ২০০ টাকা, এবং মুগডাল চাষে ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। একই পরিমাণ জমিতে বেড পদ্ধতিতে ধান চাষে ২ হাজার,  গম চাষে ৬০০ এবং মুগডাল চাষে ৬০০ টাকা খরচ হয়। এক্ষেত্রে কৃষকের খরচ সাশ্রয় ধানে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, গম এবং মুগডালে ৫০ শতাংশ। চাষের এই কৌশল ছড়িয়ে দিলে কৃষক ও প্রকৃতি দুটিই বাঁচবে বলে জানান এই গবেষক।

 


 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর