প্রকাশিত:
৮ আগষ্ট ২০২৩, ২২:৫১
একেবারে ছোটবেলা থেকে সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে আমার এতোটা আগ্রহ ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে কোনো পেশাতেই আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে সময় টিভির রিপোর্ট দেখে ভালো লাগতো। ভাবতাম পেশাটা ভালোই, ক্যারিয়ার হিসেবে নিলে মন্দ হয় না। তখন থেকেই মোটামুটি ভালো লাগা শুরু। তবে পরিবার থেকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বলা হতো। উচ্চ মাধ্যমিকে এসে পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা ভেবেই ডাক্তারি চিন্তা শেষ করে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম। আবারও ইচ্ছা জাগলো সাংবাদকতায়।কিন্তু সেই সময়টা এতো কিছু ভাবার ছিল না। তাই তেমন গুরুত্ব দিই নি।
অনার্সে ভর্তি হলাম দেশসেরা রাজশাহী কলেজে। এখানে এসেই রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (আরসিআরইউ) যোগ দেওয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হলো। অনার্স ২য় বর্ষের প্রথম দিকে একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালের (বাংলার জনপদ) মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সাংবাদিকতাকে বলা হয়, রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। যাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু আজকে কিছু সাংবাদিক নামধারী মহান পেশাটিকে কলুষিত করছে। সাংবাদিকতা মহৎ পেশা এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে, বর্তমানে যা হচ্ছে তা দেখে আমি বিড়ম্বনায় পড়ে গেছি। আসলে আমি যেই সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটার করতে পারবো তো?
বলার অপেক্ষা রাখেনা, কিছু প্রতারকদের জন্য সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশা আজ কলঙ্কিত। টাকার বিনিময়ে কার্ড ধরিয়ে দিচ্ছে রাস্তার হকার থেকে শুরু করে টমটমচালক, কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রি, হোটেলের ম্যানেজার থেকে বাবুর্চী পর্যন্ত সবার হাতে। সবাই এখন সাংবাদিক। হোটেলের বেয়ারার কাছে কয়েকদিন আগে দেখলাম, প্রেস-কার্ড! দেখে একটু অবাক-ই হলাম।
এরা যদি প্রেস-কার্ড নিয়ে ঘোরে, তাহলে পড়াশোনা সাংবাদিকতা করে লাভ কি? হোটেল বাণিজ্য করেই সাংবাদিকতা করা যাবে। শুধু এখানেই শেষ নয়; জেলা প্রতিনিধি, ক্রাইম রিপোর্টার আর বিশেষ প্রতিনিধির তমকাধারী এ প্রতারকরা সর্বত্র বিচরণ করছে। হুমকিদাতা, টাকা দাবিকারী আর টাকার বিনিময়ে কার্ড-বাণিজ্য করছে অহরহ।
এখন আবার নানা কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের এমআর, এসআররা কার্ডধারী কথিত সাংবাদিক। নানা দোকানে অর্ডার নিতে গিয়ে দেখি স্বগৌরবে পরিচয় দেয় “সাংবাদিকতা করি”! হায় সাংবাদিকতা!
বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিক নামধারী দোকানীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। রাজশাহীর মত বিভাগীয় শহরেও স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন অনেকে ব্যুরো অফিস খুলে বসেছেন। আর কতো এদের দৌরাত্ম্য? আসলেই এসব অপসাংবাদিকতার জন্যই, এই পেশা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। এবং নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি। “যারা পেশাদার সাংবাদিক, মানুষ তাদেরকে এমনিতেই চেনে। কার্ড দেখে চিনতে হয় না।
সাংবাদিকের আচার-আচরণ, কথাবার্তা দেখলেই বোঝা যায়। কেনো যেন মনে হয়, ভূঁইফোড়রাই কিভাবে কীভাবে ম্যানেজ করে নেয় আমাদের সমাজপতি, পুলিশ-প্রশাসন, রাজনীতিবীদসহ সমাজের উচ্চবিত্তদের। আর যারা তেলবাজ কিংবা চাটুকার নয় তাদের অনেককেই লোকে সাংবাদিক হিসেবে অযোগ্য ভাবে। এ কথা-ই সত্য যে, আমাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা সমাজব্যবস্থা তাতে যোগ্যতম কেউ আর সাংবাদিকতায় আগ্রহবোধ করেন না।
বিভিন্ন যায়গায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে “ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার চা-দোকানি, সেলসম্যান, ফুচকা-চটপটিওয়ালা, বাদামওয়ালা, আইসক্রিম বিক্রেতাসহ অনেকে এ পদের কাবিল হয়েছেন। এসেছেন সাংবাদিকতা পেশায়। কিন্তু প্রশ্ন এ পেশায় কিছু মানুষ এতো আগ্রহী কেন?
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, একটা সময় তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের পেশা ছিল সাংবাদিকতা। সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই তারা বেছে নিতেন। এখন অনেকটায় বদলে গেছে কথাটি। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার হার হয়তো বেড়েছে, কিন্তু পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতায় আসার হার কমে যাচ্ছে। আবার যারা এসেছেন, তাদের অনেকেই এই পেশা ছেড়েছেন। আর যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন। সুযোগ পেলেই অন্য কোনো চাকরিতে চলে যাচ্ছেন তারা। গেলো এক বছরে আমার পরিচিত অনেকেই সাংবাদিকতা পেশা ছেড়েছেন।
বিশেষ করে মেধাবী সাংবাদিকরা, যাদের রিপোর্ট আলোচনায় ছিল, যারা নজরকাড়া প্রতিবেদন করেছিলেন, তেমন কেউ যখন সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন, তখন বিষয়টি মনকে নাড়া দেয়। তারা কেন এই মহান পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ধাবিত হচ্ছেন? তাহলে কি এর জন্য সমাজ দায়ী না অপসাংবাদিকতা? নাকি তারা তাদের মান পাচ্ছেন না বলে চলে যাচ্ছেন অন্য পথে?
এদিকে যেমন মেধাবীরা সাংবাদিকতা ছাড়ছেন, অপরদিকে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন অযোগ্য, অপসাংবাদিকতা সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে ফেসবুক সাংবাদিকতা।
জেনে রাখতে হবে, একটি সভ্য দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সাংবাদিক সমাজ। কোনো দেশের সাংবাদিক সমাজ যখন দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখে, তখনই সেই দেশ এগিয়ে যায়। সাংবাদিকরা যখন তৈলাক্ত পথে হাঁটেন, তখন সেই দেশও তৈলাক্ত পথ বেয়ে নিচে নেমে যায়।
সংবাদপত্র হচ্ছে আয়নার মতো। আয়না কখনো মিথ্যা বলে না। যে আয়না মিথ্যা বলে, সেটি আয়না নয়, অন্য কিছু। তার মানে হচ্ছে, যে সংবাদপত্র মিথ্যা বলে, সেটি সংবাদপত্র নয়। এক ফালি ছাপা কাগজ মাত্র।তাই আমাদের এই অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে প্রতিবাদী হতে হবে। না হলে ইজ্জত বাঁচাতে আমাদের এ পেশা ছেড়ে পালাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র।
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ
সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ)।
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: