প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বার ২০২৩, ১৫:৫৭
ঘাড় থেকে শুরু করে কোমরের নিচ পর্যন্ত শরীরের অনেকগুলো হাড় এক হয়ে মেরুদণ্ড সৃষ্টি করেছে। এ মেরুদণ্ডই হচ্ছে স্পাইন। দেহের হাড় ও জয়েন্টকে সব সময় সচল ও কর্মক্ষম রাখতে হলে সঠিক নিয়মে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলাও জরুরি। মেরুদণ্ডের বিভিন্ন সমস্যায় করণীয় নিয়ে লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলসের ওয়াল্টার্স রোড মেডিকেল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল ফিজিশিয়ান ডা. চৌধুরী সাইফুল আলম বেগ।
কোমর ব্যথা বা লো ব্যাকপেইন
লো ব্যাকপেইন অনেকেরই নিত্যদিনের সমস্যা। ঋতু পবির্তনের সময়ে ব্যথা যেন আরও বাড়ে। ব্যথার কারণ কিন্তু লাইফস্টাইল। বিশেষত যাদের দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে কাজ করতে হয়। মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসার কথা কারোই মনে থাকে না। ছুটি শেষে অফিসে ফিরে আবার দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ-এভাবে বসার সঙ্গে লো ব্যাকপেইন কিন্তু ইন্টারলিঙ্কড।
মেরুদণ্ডের একটা নির্দিষ্ট আকার রয়েছে। ঠিকভাবে না বসলে আকার বজায় থাকে না। অ্যালাইনমেন্ট নষ্ট হয়। বেশিক্ষণ সামনে ঝুঁকে বসলে কোমরের ডিস্কে চাপ পড়ে বেশি। তার থেকেও এ ধরনের ব্যথা হয়। ব্যথার দ্বিতীয় কারণ হলো, বেশিক্ষণ একটানা বসে থাকার ফলে হিপের পেশির সংকোচন। এতেও মেরুদণ্ডের অ্যালাইনমেন্ট নষ্ট হয়। ফলে কোমরে ব্যথা হয়। অনেকেই হিল পরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। তা থেকেই গোড়ালি বা কোমরে ব্যথা তৈরি হয়। আপনি যখনই হিল পরছেন, কোমর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ালে কোমরে যে চাপ পড়ে, হিল পরার কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি চাপ পড়ে। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে তাপমাত্রার তারতম্য হয় বলে মাসল টাইটনেস বাড়ে। এই সময়ে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার পরে ঘুম থেকে উঠলেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। কিছুক্ষণ চলাফেরার পরে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হলে সে ব্যথা চলে যায়।
ব্যথার উপশম কীভাবে হবে
প্রথমেই বসার ভঙ্গি ঠিক করতে হবে। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করলে কাঠের চেয়ারে বসুন। দ্বিতীয় হলো স্পাইনাল স্টেবিলাইজেশন। অর্থাৎ মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখার জন্য কিছু ব্যায়াম। দেখা গিয়েছে, লো ব্যাকপেইন শতকরা নব্বই শতাংশ লোকের ক্ষেত্রেই ঝুঁকে কাজ করার কারণে হয়। এ জন্য দরকার এক্সটেনশন, মেরুদণ্ডকে প্রসারিত করার ব্যায়াম।
বার্ড ডগ : দু’হাতের তালু ও হাঁটু মাটিতে রেখে মেরুদণ্ড টানটান রাখুন। ডান হাত ও বাঁ পা প্রসারিত করে ধরে রাখুন। দশ সেকেন্ড করে ধরে রাখতে হবে। দু’দিকেই অর্থাৎ ডান হাত, বাঁ পা এবং বাঁ হাত, ডান পা, ছয় থেকে আট বার করতে হবে।
ব্রিজ : মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন। দুটি হাঁটু নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ভাঁজ করে কোমরটাকে শূন্যে ধরে রাখুন। বুক এবং হাঁটু যেন এক রেখায় থাকে। দশ সেকেন্ড করে ধরে রাখতে হবে। ছয় থেকে আটবার এক্সারসাইজটি করতে হবে।
সাইড প্ল্যাঙ্ক : পাশাপাশি কনুই আর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে শরীরটাকে শূন্যে তোলা। ডান কনুই ও ডান পায়ের পাতায় ভর রেখে শরীরকে শূন্যে দশ সেকেন্ড তুলে রাখুন। এভাবে বাঁ দিকেও করুন। তিন থেকে চার বার এক্সারসাইজ করুন।
ডেড বাগ : মাটিতে শুয়ে পড়ুন। দুটি হাঁটু শূন্যে ভাঁজ করে কোমরের ওপরে তুলুন। দুটি হাত একসঙ্গে সোজা করে তুলে রাখুন। এবার সাইকেল চালানোর ভঙ্গিতে ডান হাত ও বাঁ পা এবং বাঁ হাত ও ডান পা প্রসারিত করুন। পর্যায়ক্রমে ডান পা ও বাঁ হাত, বাঁ পা ও ডান হাত প্রসারিত করুন। দু’দিকেই বারো বার করে করুন। এ ব্যায়ামটি অবশ্য ডান হাত ও ডান পা প্রসারিত করেও করতে পারেন। তিন থেকে চারবার করে রিপিট করুন। এক্সারসাইজ বাছার সময়ে দেখতে হবে, জীবনযাত্রার ধরন এবং কী কারণে ব্যথা হচ্ছে।
এ কটি এক্সারসাইজ কিন্তু যারা বসে কাজ করেন, তাদের জন্য খুব উপকারী। আবার দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যাদের কোমরে ব্যথা, তাদের জন্য ফ্লেকশন বেসড এক্সারসাইজ উপকারী, যাতে মেরুদণ্ডের সামনের দিকের পেশির জোর বাড়ে। ব্যথা কমানোর জন্য যে রকম জোর বাড়ানো দরকার, তেমনই অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখার জন্যও পেশির স্ট্রেচিং দরকার। মেরুদণ্ডের স্টেবিলিটি এক্সারসাইজের সঙ্গেই যে পেশি সংকুচিত হয়েছে, তা দীর্ঘায়িত করার জন্য স্ট্রেচ করতে হবে। তবেই মেরুদণ্ডের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক থাকবে। তাই কোর এক্সারসাইজের সঙ্গে স্ট্রেচও করতে হবে।
হ্যামস্ট্রিংয়ের স্ট্রেচ : হাঁটুর পেছনের পেশির (হ্যামস্ট্রিং) স্ট্রেচ করতে মাটিতে বসে এক পা ভাঁজ করে, অন্য পা সোজা করে সামনের দিকে ঝুঁকুন। পায়ের পাতা স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। মেরুদণ্ড যেন টানটান থাকে। দীর্ঘক্ষণ কাজ করলে চেয়ারে বসেও স্ট্রেচটি করতে পারেন। একটি চেয়ারে বসে পা সামনের দিকে টানটান করে রাখুন। ডান পা ও বাঁ পা এভাবে দশ সেকেন্ড করে ধরে রাখুন। দু’বার করে রিপিট করুন।
গ্লুট (হিপের পেশির) স্ট্রেচ : চেয়ারে বসে ইংরেজি ফোরের মতো করে পা রেখে বসুন, (যেভাবে চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে গল্প করি) সামনের দিকে ঝুঁকুন। দশ সেকেন্ড করে দু’তিন বার করুন।
হাড় বেড়ে যাওয়া
আমাদের মেরুদণ্ড বা ব্যাকবোনে অনেকের হাড় বেড়ে যাওয়া বা হাড়ের বৃদ্ধির সমস্যায় ভুগে থাকেন। যা হাড়ের শেষভাগে দেখা যায়, বিশেষত সন্ধিস্থলে যেখানে দুটি হাড় পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। এর ফলে সুষ্মাকাণ্ড বা মেরুদণ্ডের সন্ধিস্থলে বাড়তি চাপ পড়ে। হাড় বেড়ে যাওয়া ঘটে যেখানে প্রদাহ বা আঘাত থাকে, তরুণাস্থি বা রগের কাছাকাছি। হাড় বেড়ে যাওয়া সাধারণত যেখানে হয়-
> পায়ের গোড়ালির হাড়ের নিচের তলে-যাকে গোড়ালির হাড় বৃদ্ধি বলে। এটা যন্ত্রণাদায়ক।
> হাত-হাড় বৃদ্ধি হাতের আঙুলের সন্ধিতে হয়, যাতে আঙুল নাড়ানো সম্ভব হয় না।
> কাঁধ-হাড় বৃদ্ধি রগে ব্যথার সৃষ্টি করে (রগের ব্যথা) যেহেতু কাঁধের চক্রাকার স্থানে রগ আর পেশির মধ্যে ঘর্ষণ হয়। ফলে কাঁধ সঞ্চালনে বাধা দেয়।
> সুষ্মাকাণ্ড বা স্পাইনাল কর্ড-সুষ্মাকাণ্ড সরু হয়ে যাওয়া, যাকে স্পাইনাল স্টেনোসিস বলে, যা হাড় বৃদ্ধির জন্যই ঘটে। এটি যন্ত্রণার কারণ হয়, অসাড়তাও হয়। স্নায়ুগুলোতে সংঘর্ষের কারণে পায়ে দুর্বলতা দেখা যায়।
> নিতম্ব ও হাঁটু-হাড়ের বৃদ্ধির ফলে হাঁটার গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
কখনো কখনো, হাড় বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো উপসর্গ থাকে না। হাড় বৃদ্ধি যন্ত্রণার কারণ ঘটায়, অসাড়তা এবং আশপাশের পেশিতে, রগে, স্নায়ুতে বা ত্বকে অস্বস্তির জন্য আক্রান্ত অংশে সংবেদনশীলতা দেখা যায়। গোড়ালিতে হাড় বৃদ্ধি হলে হাঁটতে অসুবিধা হয়, সঙ্গে সংবেদনশীলতা এবং ফোলাভাব দেখা যায়। কখনো কখনো, যদি হাড় বৃদ্ধি গোড়ালির একদম নিচে হয়ে থাকে তখন পায়ের নিচে ব্যথার সৃষ্টি হয়। সুষ্মাকাণ্ডে যদি হাড় বৃদ্ধি পায় স্নায়ুগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, যাতে অসাড়তা দেখা যায়, এই স্নায়ু শরীরের যে অংশে বাহিত হয় সেখানে ব্যথার সৃষ্টি হয়। যখন হাড় বৃদ্ধি থেকে কোনো ব্যথা সৃষ্টি হয় না বা কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না, তখন এক্স-রের মাধ্যমে তা ধরা পড়ে।
প্রধান কারণ
> হাড় বৃদ্ধি সাধারণত ব্যথাভাব ও চাপভাবের সৃষ্টি করে।
> অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা হাড়ের বাত একটি পুনরুৎপাদনকারী হাড়ের সন্ধির রোগ, যা হাড় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে এটি খুবই চোখে পড়ে। যখন আমাদের বয়স হয়ে যায়, হাড় ও জয়েন্টের ব্যবহারের ফলে তরুণাস্থির ক্ষয় হয়, এতে হাড়ের ভর কমে যায়। অবস্থা সামাল দিতে শরীর হাড় বৃদ্ধি ঘটায়।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
> পরীক্ষা করে দেখার সময়, হাড়ের সন্ধির আশপাশে হাত দিয়ে একজন চিকিৎসক ব্যথার জায়গাটি খোঁজার চেষ্টা করেন। এই জায়গাটির এক্স-রে করাতে বলতে পারেন। অন্যান্য ইমেজিং টেস্ট, যেমন এমআরআই স্ক্যান, সিটিস্ক্যান, মাইলোগ্রাম করাতেও বলতে পারেন।
> রোগ নির্ণয় হয়ে গেলে, ব্যথা ও অস্বস্তিভাব কমানোর জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। ওই স্থানটিতে ঠান্ডা সেঁক নিলে তাও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।
> গোড়ালির হাড় বৃদ্ধির জন্য বিশেষ জুতা ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। লম্বা সময় ধরে ব্যথা থাকলে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
> বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়, শারীরিক থেরাপি, কাজকর্মের কিছু পরিবর্তনও দরকার পড়ে। যদি হাড়ের বৃদ্ধির জন্য স্নায়ুতে চাপ পড়ে তবে প্রচণ্ড যন্ত্রণার কারণ হতে পারে, তখন সার্জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। সূত্র: যুগান্তর
বাংলা গেজেট/বিএম
মন্তব্য করুন: