[email protected] শনিবার, ২৩শে নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

উত্তরের শিশুদের বিপদ ডেকে আনছে অপুষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
৯ আগষ্ট ২০২৩, ০৬:৪০

উত্তরাঞ্চলের শিশুদের মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে অপুষ্টি। শিশুরা বেড়ে উঠছে কম শারীরিক বৃদ্ধি নিয়ে।

উত্তরাঞ্চলের শিশুদের মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে অপুষ্টি। শিশুরা বেড়ে উঠছে কম শারীরিক বৃদ্ধি নিয়ে। বুদ্ধিগত বিকাশও হচ্ছে ধীরে। শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে প্রতিবন্ধিতার দিকেও। রক্তাল্পতা থেকে ঝুঁকি বাড়ছে হৃদরোগের। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণও বাড়ছে। সম্প্রতি আলাদা গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। মায়েদের পুষ্টি সচেতনতার অবভাবে সংকট ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

সম্প্রতি মাতৃ পুষ্টি জ্ঞান এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে শিশুর পুষ্টির অবস্থার নির্ধারক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে বাংলাদেশ জার্নাল অফ মাল্টিডিসিপ্লিনারি সায়েন্টিফিক রিসার্চ। এর প্রধান গবেষক হাজি দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিলকিস বানু।

তিনি জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলে শিশুদের প্রতিপালনে মায়েদের পুষ্টি জ্ঞানের বর্তমান অবস্থা চিহ্নিত করতে এই গবেষণা চলান তারা। পুষ্টি জ্ঞান জানতে তারা ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সি বাচ্চা রয়েছে এমন ৫৩৭ জন মায়ের সরাসরি সাক্ষাতকার নেন। প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মায়েদের এই গবেষণার আওতায় আনা হয়।

রাজশাহী বিভাগের ২৯১ জন মায়ের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার ৮৯জন, নওগাঁর ৪৩ জন, সিরাজগঞ্জের ৭৪ জন এবং বগুড়ার ৮৫ জন। অন্যদিকে, গবেষণায় অংশ নেন রংপুর বিভাগের ২৪৬ জন মা। এরমধ্যে রংপুর জেলার ৭২ জন, দিনাজপুরের ৫৯ জন, গাইবান্ধার ৬০ জন এবং পঞ্চগড়ের ৫৫ জন।

গবেষক জানান, গবেষণায় অংশ নেয়া প্রায় ৫৬ শতাংশ মায়ের শিশু পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান নেই। মাত্র ৭ শতাংশ মা খুব ভালো জ্ঞান রাখেন। এছাড়া ৩৭ শতাংশ মায়ের পুষ্টি জ্ঞান দুর্বল। কিছু মা কর্মজীবী হওয়ায় শিশু যত্নের জন্য আলাদা লোক রেখেছেন। তাদেরও আনা হয়েছে এই গবেষণার আওতায়। এদের ৫৮ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এছাড়া ৭ শতাংশ প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। ১১ শতাংশ প্রাথমিক পেরিয়েছেন। বাকি ১৪ শতাংশ মাধ্যমিক শেষ করেছেন। ফলে তাদের পুষ্টিজ্ঞানও সীমিত।

তিনি আরও জানান, উত্তরদাতাদের প্রায় ৬২ শতাংশ প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ রঙের খাবার দেয়ার চেষ্টা করে। ৪১ শতাংশ মা শিশুর দুধে চিনি যোগ করেন। সন্তানের খাবারের মেনু ঘন ঘন পরিবর্তন করেন ৪১ শতাংশ মা। প্রায় ৯৭ শতাংশ মা শিশুকে কোলস্ট্রাম খাওয়ান। ৮৮ শতাংশ মা শিশুর খাদ্যতালিকায় আধা-সলিড খাবার দেন। ৬৬ শতাংশ জানেন শিশুরা প্রতিদিন কী খাবার খায়। প্রায় ৭৩ শতাংশ মা বাচ্চাদের ফাস্ট ফুড দেন। প্রায় ৫০ শতাংশ মা নিয়মিত বাচ্চাদের ওষুধের জন্য ডাক্তারের কাছে যান।

এ প্রসঙ্গে বিলকিশ বানু জানান, নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মায়েদের শিক্ষার স্তর কম এবং একচেটিয়া স্তন্যপান না করা পরিবারগুলিতে দরিদ্র পুষ্টির অবস্থা বেশি ছিল। শৈশবের অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুষ্টি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের পুষ্টি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে শিশুর অপুষ্টির সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা অনেক বেশি। এজন্য প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং সেবিকাদের মাধ্যমে মায়েদের আরও বেশি সচেতন করা প্রয়োজন।

এদিকে, অপুষ্টি থেকেই আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা বা এনিমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এনিমিয়া আক্রান্ত অধিকাংশ শিশু  শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের শিকার হচ্ছে। বিষয়টি উঠে এসেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) একদল চিকিৎসকের আরেকটি গবেষণায়।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী মেডিকো রিসার্চ ক্রনিকলস। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৬০ শিশুর ক্লিনিকাল উপস্থাপনা এবং পরীক্ষাগার প্রোফাইল বিশ্লেষণ করা হয় এই গবেষণায়।

ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই ৬০ জন শিশু শ্বাসযন্ত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। যাদের বয়স ৫ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে। রোগীদের আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা ৩৩ শতাংশের উপরে। হিমগ্লোবিনের পরিমাণ ছিল ১১ গ্রামের কম।

ক্লিনিকাল মূল্যায়নে, ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীর চেহারা ফ্যাকাশে দেখা গেছে। হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসকষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীর। বুকে আঁকতে দেখা গেছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশকে। এছাড়া শ্বাস নেয়ার সময় শব্দ পাওয়া গেছে ১০ শতাংশের। বড় বড় শ্বাস নেয়ার সময় আঘাত এবং শব্দ পাওয়া গেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশের। অ্যাজমার উপসর্গ পাওয়া গেছে ৯০ শতাংশেরই।

গবেষক দলটির প্রধান রামেকের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতা এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্র খুঁজতে তারা এই গবেষণাটি চালিয়েছেন। রক্তাল্পতার একটি বড় কারণ পুষ্টিহীনতা। পুষ্টিহীনতায় হৃদরোগসহ শিশুদের নানান জটিল-কঠিন রোগ সৃষ্টি করে। এ জন্য বৃহৎ জনসংখ্যার উপর দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা প্রয়োজন।

এদিকে, ২০২৩ সালের ২৩ মে প্রকাশিত ‘শিশু অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অপুষ্টির শিকার ৫ বছরের কম বয়সি শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। বয়সের তুলনায় এদের উচ্চতা কম বা খর্বকায়। ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ ৪৬ হাজার বা ৩৯ শতাংশ। বর্তমানে এই সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার বা ২৬ শতাংশ। এছাড়া ১৪ লাখ ৩৮ হাজার বা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু রোগা-পাতলা বা কৃষকায়।

 তবে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য বলছে, দেশে ২৪ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। অর্থাৎ দেশে চারটি শিশুর মধ্যে একটি শিশুর উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তবে গত কয়েক দশকে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে নানা ধরনের উদ্যোগের ফল এটি।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) প্রকাশিত এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশু ছিল ৪১ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। ৩১ শতাংশে নেমেছে ২০১৮ সালে। সর্বশেষ ২০২২ সালে তা নেমেছে ২৪ শতাংশে।

জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের শিশুপুষ্টির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশে কম ওজনের শিশুর হার কমছে না। বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সী কম ওজনের শিশু ২২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালেও এ হার ছিল ২২। অন্যদিকে, কৃশকায় শিশুর হার বাড়ছে। ২০১৭-১৮ সালে কৃশকায় শিশু ছিল ৮ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। এটি পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতির লক্ষণ।

 বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের রংপুর অঞ্চলের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা সাধারণ ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের দানাদার বা শষ্য, ডাল বা ডাল জাতীয়, বীজ বা বাদাম, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ, ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ শাক-সবজি এবং অন্যান্য শাক-সবজি খাওয়ানোর কথা বলি। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের শিশুরা দানাদার খাবারের পাশাপাশি দুধ এবং মাছ-মাংস খায়। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ শাক-সবজির খাওয়ানো যাচ্ছেনা। বিশেষ করে দুই বছরের নিচে শিশুদের এই সংকট প্রকট।

তিনি যোগ করেন, পুষ্টি প্রতিটি শিশুর অধিকার। কিন্তু শিশুর পুষ্টি জলবায়ু পরিবর্তন বড় হুমকি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে করোনা মহামারিকালে কাজ হারিয়ে অগণিত পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এখন মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা পরিবারগুলো চাহিদামত পুষ্টির যোগান দিতে পারছেনা। পরিবারের আয় কমে গেলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হবে—এটাই স্বাভাবিক।

এবিষয়ে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালক ডা. এবিএম আবু হানিফ বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের পুষ্টি সমস্যা নতুন নয়। এটি মায়েদের থেকেই আসছে। সংক্রমণ ব্যধিগুলো পুষ্টিহীনতা থেকেই আসছে। এ জন্য দেশে সমন্বিত টিকাদানসহ বিভিন্ন কার্যাক্রম চালু রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করছেন। পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নিত হয়েছে। আমাদের আর উন্নতি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকএবংইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রএই সংক্রান্ত সেবা দেয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসায় বিশেষ কর্ণার চালু রয়েছে। এখানে প্রশিক্ষিত নার্স ও চিকিৎসক রয়েছেন। নিবিড় সেবার মাধ্যমে চিকিৎসার পাশাপাশি সেখানে থেরাপিউটিক খাবারও পাচ্ছে আক্রান্ত শিশুরা।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর