[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আমের শহরে পানের রাজত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
২৪ নভেম্বার ২০২৩, ২১:২৮

ফাইল ছবি
আমের জন্য রাজশাহীর সুখ্যাতি বেশ পুরনো। আমের পরিচয়েই রাজশাহীর পরিচয়। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, বছরে রাজশাহীতে আম থেকে যে পরিমান আয় হয়, তার দ্বিগুণ আয় হয় পান থেকে। পান এখন এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল। আমের রাজ্যখ্যাত এ জেলায় এখন রাজত্ব করছে পান। লক্ষাধিক পরিবার নির্ভরশীল এ পানের ওপর। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখানকার পান রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। কৃষকরা বলছেন, বরজে পান আছে মানে, ব্যাংকে টাকা আছে। তবে আমের মতো আলোচনা আর গবেষণা নেই পান নিয়ে।
 
কৃষিবিদ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকিয়ে রাখতে পারলেই চাষির মুখে হাসি ফোটে। অথচ রাজশাহীর আম নিয়ে যত মাতামাতি, পান নিয়ে ততটা নেই। সারা দেশে জায়গা না থাকায় পান আলোচনায় আসে না। তবে এরই মধ্যে জেলার মোহনপুরে পান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া পানের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে জেলা প্রশাসন। এবছর বুধবার (৩০ আগস্ট) জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে জিআই আবেদনের সব প্রক্রিয়ার সম্পন্ন করেছেন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ।
 
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, বর্তমানে রাজশাহীতে ৪ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমিতে পান আবাদ হচ্ছে। সর্বশেষ বছরে উৎপাদিত পানের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৬৭৮ মেট্রিক টন। জেলার বাগমারায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৬০ হেক্টর ও মোহনপুরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ করছেন কৃষকরা।
 
সূত্রমতে, জেলায় প্রায় ৩৯ হাজার পানচাষি রয়েছেন। আরও প্রায় ৪০-৪৫ হাজার পরিবার পানবরজের শ্রমিক, ব্যবসা ও পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জেলায় বড় পানের হাট রয়েছে ২০-২৫টি। এরমধ্যে বাগমারার মচমইল, মোহনপুরের একদিলতলা, পাকুড়িয়া, মৌগাছি ও ধুরইল এবং দুর্গাপুরের দাওকান্দি বাজার উল্লেখযোগ্য। তবে মোট পানচাষির মধ্যে ১৭ হাজার ৮৫০ জনই মোহনপুরের।
 
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মোহনপুর ও পবায় বিস্তৃত মাঠের মধ্যে খড়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে। ধান ও পটল আলু, করলা, লাউসহ বিভিন্ন সবজি চাষের জমিতে নতুন নতুন পানবরজ তৈরি করেছেন কৃষকরা। নিরাপত্তার জন্য খড়ের বেড়ার বাইরে নীল রঙয়ের জাল (নেট) দিয়ে ঘিরে রেখেছেন তারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যার প্রকোপ কমে আসায় নিচু জমিতেও অনেকে পানচাষ করছেন। পানবরজের চতুর্পাশে সুপারি গাছ লাগিয়েছেন অনেক কৃষক। এছাড়া পুঁইশাক লাগিয়ে লতাগুলো ওপরে খড়ের ছাউনির ওপর তুলে দিয়েছেন।
 
পান চাষিরা জানিয়েছেন, পানের লম্বা লম্বা সারিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘পিলি’ বলে চিহ্নিত করেন তারা। প্রতি পিলিতে পানগাছের লতা স্থির রাখার জন্য বাঁশ কেটে বিশেষ ধরনের কঞ্চি তৈরি করা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এ কঞ্চিকে তারা ‘ওয়াশি’ বলে থাকেন। বাঁশের খুঁটিকে ‘লগোইড়’ বলেন চাষিরা। পানবরজের পরিমাণকে ‘পোন’ বলে হিসেব করা হয়। ৮০ লগোইড়কে এক পোন বলেন তারা। প্রায় ৫ কাঠা জমিতে ৪ পোন লগোইড়ের পানবরজ স্থাপন করা যায়। এছাড়া, পানের পরিমাণকে বলা হয় ‘বিড়া’। ৬৪টি পানপাতাকে এক বিড়া পরিমাণ ধরা হয়। এরকম ৩২ বিড়াতে ধরা হয় ‘এক পোন’। প্রতিটি লতায় প্রায় ২০টি করে পানপাতা থাকে। বছরে ৩-৪ বার বিশেষ পরিচর্যা নিতে হয় পানবরজের। প্রত্যেকবার পরিচর্যার জন্য বিঘাপ্রতি ২০ জন করে শ্রমিক প্রয়োজন হয়।
 
পানের লতা ওয়াশির সঙ্গে আটকিয়ে রাখতে খড় দিয়ে ছোট সাইজের তৈরি বিশেষ ধরনের বস্তু ব্যবহৃত হয়। সেটিকে তারা ‘উইল্যা’ বলেন। পানগাছের গোড়াকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘পড়’ বলে সম্বোধন করেন চাষিরা। পানের আকৃতি অনুযায়ী ভিন্ন নামে ডাকা হয়। সবচেয়ে বড় পাতাকে ‘মোটা’ পান ও সবচেয়ে ছোট সাইজের পানকে ‘সাপটা’ পান বলা হয়। এছাড়া মধ্যম সাইজের পানকে মাঝারি ও সব মিশ্রিত পানকে একত্রে ‘ঝাড়া’ নামে ক্রয় করেন পান ব্যাপারীরা। এ ফসলের নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। সারাবছর উৎপাদন হয়। লাভও বেশি।
 
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আজাহার আলীর বাসা মোহনপুরের হরিহরপাড়া এলাকায়। কিশোর বয়স থেকেই পানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত। মাত্র ১৫ কাঠা জমির পানবরজ থেকে প্রতিমাসে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা ইনকাম করছেন তিনি। আজাহার আলী বলেন, যার এক বিঘার পানবরজ রয়েছে, তার বছরে ৫-৬ লাখ লাভ হয়। সপ্তাহে দুদিন পান বিক্রি করা যায়। এছাড়া টাকার দরকার হলেই ভেঙে নগদ নগদ বিক্রি করে প্রয়োজন পূরণ হয় আমাদের।
 
মোছা. শাবানা বেগম নামে নাম এক নারী বলেন, এক বিঘা পানবরজওয়ালার সঙ্গে ১০ বিঘা জমিওয়ালা পারবে না। পান এমন ক্ষ্যাত, পান যদি টিক্যা থাকে, তে এর মতো শান্তি আমরা জীবনেও পাই না। আর যদিও মইরা যায়, তাহলে আমরাও মরা।
 
সূত্র জানিয়েছে, সরকার মোহনপুর উপজেলায় পান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা প্রায় ৫-৬ মাস আগে মোহনপুরের সম্ভাব্য দুটি জায়গা পরিদর্শন করে এসেছেন। জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে এ উপজেলার অবস্থান। এমনটা হলে পানচাষিদের অপার সম্ভবনার দুয়ার খুলবে বলে মনে করছেন জনপ্রতিনিধি ও কৃষি কর্মকর্তারা।
 
এ ব্যাপারে মোহনপুরের মৌগাছি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আল-আমিন বিশ্বাস বলেন, পানে বিপ্লব অলরেডি হচ্ছে। এখানকার ৭০ শতাংশ মানুষ পান চাষ করে। এখানে ধান, আলু, পান অনেক চাষ হয়। বিশেষ করে, পানটা সবচেয়ে মূল্যবান ফসল মনে হয়। এটা আমরা নিজেরা নিজেরা চাষ করি। এটা লাভজনক ফসল। আলু রাখার মতো পান সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা বা গবেষণা কেন্দ্র হলে কৃষকের উপকার হবে।
 
মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা. মোস্তাকিমা খাতুন বলেন, পান অর্থকরী ফসল তো বটেই, এটার অনেক ওষুধি গুণও রয়েছে। এখানে গবেষণা কেন্দ্র হলে পানচাষিরা নিরাপদে পান উৎপাদন করতে পারবেন। এছাড়া, বৈদশিক মুদ্রাও অর্জন হবে।
 
এ ব্যাপারে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, পানে লাভ হচ্ছে। কিন্তু আমরা চাচ্ছি, পানবরজের ভেতরেও দুইটা লাইনের মাঝখানে একটা গ্যাপ থাকে; এই গ্যাপে ছায়াযুক্ত স্থানে আদা আর হলুদ হয়ত এবছরই ইন্ট্রোডিউস করব। তাহলে এটা করলে তাদের পানের পাশাপাশি এখান থেকে কিছু লাভ হবে। এবং আদা ও হলুদ দিলে পান বরজে যে প্রবলেম আছে আপাতত, প্রবলেমগুলো কমে যাবে বলে আমরা করছি। তাহলে সেখানে একটা পরিবর্তন হবে। আরও বেশি মানুষ পানবরজ করতে আগ্রহী হবে। বর্তমানে রাজশাহীর পান বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।#
 

বাংলা গেজেট/এমএএইচ


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর