প্রকাশিত:
২০ অক্টোবার ২০২৩, ২১:২৩
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষানবিশ নার্সদের মাসিক ৭ হাজার করে ৬ মাসের ইন্টার্নশিপে ৪২ হাজার টাকা দেয়ার কথা থাকলেও কোনো টাকা পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। উল্টো তাদের কাছ থেকেই টাকা আদায় করেন বলে জানা গেছে। বছরের পর বছর এমন বৈষম্য ও নিগ্রহের শিকার রাজশাহী অঞ্চলের বেসরকারি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রহস্যজনক কারণে বিএসসি কোর্সের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্ন বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব নার্সিং কলেজের স্ব স্ব হাসপাতালে ইন্টার্নশিপের সুযোগ থাকলেও সেখানে বিনা পারিশ্রমিকে দৈনিক সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের! ১১টি বেসরকারি নার্সিং কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর দিকে কারও নজর নেই! রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে নার্সিং সেক্টর তারা দেখেন না।
জানা গেছে, বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) পরিচালনায় দেশে বর্তমানে চার কোর্সে নার্সিং শিক্ষা চলমান। নার্সিংয়ের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে চার বছর মেয়াদী বিএসসি-ইন-নার্সিং কোর্সকে অনার্স সমমানে উন্নীত করে সরকার। একাডেমিক অধ্যায়ন শেষে হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের ৬ মাস ইন্টার্ন বাধ্যতামূলক। সকাল, সন্ধ্যা ও রাত- এ তিন শিফটে সপ্তাহে ৬ দিন ডিউটি করতে হয় তাদের। সকাল ও সন্ধ্যার শিফটে ৬ ঘণ্টা করে এবং রাতের শিফটে ডিউটি করতে হয় ১২ ঘণ্টা।
সূত্র জানায়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত ১৪টি নার্সিং কলেজের সবশেষ পাশকৃত ২০১৭-১৮ সেশনের বিএসসি কোর্সের ৫০৯ জন শিক্ষার্থী ইন্টার্ন করছেন। এরমধ্যে ৩টি সরকারি নার্সিং কলেজের ২৬৪ জন শিক্ষার্থী নামমাত্র ইন্টার্নশিপ ভাতা পেলেও বঞ্চিত ১১টি বেসরকারি নার্সিং কলেজের প্রায় আড়াইশো শিক্ষানবিশ নার্স। চরম নিগ্রহের শিকার হয়ে উল্টো বিভিন্ন শাস্তির মুখে পড়তে হয় তাদের। নিয়মের বেড়াজালে অনেক সময় হেনস্থার শিকারও হন বেসরকারি নার্সিংয়ের শিক্ষার্থীরা। হাসপাতালের ওয়ার্ডে পৌঁছতে এক মিনিট দেরী হলেই ওইদিন অনুপস্থিত দেখিয়ে প্রদান করা হয় শাস্তি। বাধ্যতামূলক করিয়ে নেয়া হয় ‘ওভার ডিউটি’। বছর খানেকের ভেতর পরবর্তী দুই সেশন তথা ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ সেশনের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী ইন্টার্ন করবেন। তাদেরও একই ফাঁদে ফেলার পাঁয়তারা চলছে।
অথচ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ১৮ এপ্রিল উপসচিব ফারজানা সুলতানা স্বাক্ষরিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘শিক্ষানবিশকালে শিক্ষানবিশ শ্রমিক মাসিক সর্বসাকুল্যে ৭ হাজার টাকা প্রাপ্ত হইবে। এই প্রজ্ঞাপন ২৮ নভেম্বর, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে কার্যকর হইয়াছে বলে গণ্য হইবে।’ তবে ৬ মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি এ প্রজ্ঞাপন। যেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব নার্স নেতারা।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যায়নকালীন সময়ে বেসরকারি নার্সিং কলেজসমূহ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফিসহ নামে-বেনামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও ইন্টার্নশিপের ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কতৃপক্ষের। নিজস্ব হাসপাতালই নেই বেশিরভাগ কলেজের। মিথ্যা আশ্বাসে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে প্রতারণা করছেন শিক্ষার্থীদের সাথে। রাজশাহীতে শুধুমাত্র ইসলামী, বারিন্দ, এম রহমান ও ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন নার্সিং কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে। তবে তারাও সম্মানী দেয় না শিক্ষানবিশ নার্সদের। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ঢাকায় ইন্টার্ন করলে নামমাত্র কিছু সম্মানী পাওয়া যায়। কিন্তু রাজশাহীতে কোনো সম্মানী দেয় না ইসলামী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অথচ একই জায়গায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা প্রতিমাসে সম্মানী পান ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর সিনিয়র স্টাফ নার্সরা মাসিক বেতন পান প্রায় ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। সমপরিমাণ ডিউটি করেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত শিক্ষানবিশ নার্সরা।
নার্সিং শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতিযোগিতা ঘেরা সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ পান সংখ্যালঘু শিক্ষার্থী। সংখ্যাগরিষ্ঠদের পড়তে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। যেখানে পড়ার খরচই কমপক্ষে ২-৩ লাখ টাকা। বাসস্থান আর খাবার খরচ সব মিলে একজন শিক্ষার্থীর ৫-৬ লাখ টাকা খরচও পড়ে, যা একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রেও কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। পড়া শেষে যখন একজন শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ করেন তখন তাদের কাজ করতে হয় একজন চাকরিজীবী নার্সের মতোই। পড়ালেখা চলাকালে ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে বিভিন্ন জায়গায় ডিউটি করে বেশির ভাগ কাজ তারা শিখে ফেলে। কিন্তু কোনো ভাতা পান না তারা। বরং অনেক প্রতিষ্ঠানে টাকা দিয়ে ইন্টার্নি করার অভিযোগও রয়েছে। উন্নতমানের নার্সিং সেবার প্রত্যাশায় ইন্টার্ন নার্সদের সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক সচ্ছলতা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই অনতিবিলম্বে এ ব্যাপারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি অতীব জরুরি।
এ ব্যাপারে বেসরকারি নার্সিং শিক্ষার্থীদের সংগঠন সোসাইটি অব বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট নার্স’র (এসবিজিএসএন) কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান আকাশ বলেন, সর্বক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত। আমাদের দেখার কেউ নেই। আমিও টাকা দিয়ে সিরাজগঞ্জ মেডিকেলে ইন্টার্ন করছি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, আমরাই ৪২ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। সমপরিমাণ ডিউটি করেও আমরা বৈষম্যের শিকার।’ তিনি বলেন, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম, ওখানে ১০ হাজার টাকা চেয়েছিল; রংপুর মেডিকেলে যোগাযোগ করলাম, ওরা চেয়েছিল ৫ হাজার টাকা।’ উদয়ন নার্সিং কলেজের সদ্য পাশকৃত শিক্ষার্থী মো. সাগর বলেন, ‘সম্মানী তো দূরের কথা, রামেক হাসপাতালে আমাদেরকে ইন্টার্ন করতেই দেয় না।’ ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন নার্সিং কলেজের বিএসসি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আলভি হাসান অনিক বলেন, ‘প্রাইভেট কলেজের স্টুডেন্টদের টাকা দেয় না, উল্টা ৬ মাসের একটা অ্যামাউন্ট নেয়। এটা রীতিমত অন্যায়। আর সরকারি হাসপাতালে ডিউটি করতে বাঁধা কেন থাকবে?’
এসব বৈষম্য বন্ধ করে অবিলম্বে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত সেই প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নের দাবি নার্স নেতাদের। তারা জানান, নার্সিং পেশাকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে ভেদাভেদ ভুলে প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবেন তারা। তবে এসব বিষয়ে নার্সিং কলেজসমূহ নীরব। উদয়ন নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজা খানমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। অন্যান্য কলেজ কর্তৃপক্ষও কথা বলেনি।
আর রামেক হাসপাতালে ডিউটি বন্ধের ব্যাপারে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহম্মদের দাবি, নার্সিং সেক্টর তিনি দেখেন না। এ ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারবেন না
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: