প্রকাশিত:
১১ সেপ্টেম্বার ২০২৩, ০৩:৫৩
গত চার বছরে রাজশাহী অঞ্চলের আম উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যের পরিধিও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাগানও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিবছরই আম রফতানিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন দেশ। চলতি বছরে এ অঞ্চলের আম রফতানিতে যোগ হয়েছে আরও ৫টি দেশ। এ নিয়ে মোট ১৭টি দেশে আম রফতানি হয়েছে।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে এ অঞ্চলে আম উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন। যেখানে মোট বাণিজ্যের আশা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশে রফতানির টার্গেট আড়াই হাজার মেট্রিক টন। তবে চলতি মৌসুমের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৪৫২.১৫ মেট্রিক টন আম রফতানি হয়েছে। যা গত বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২২২.৮৮ মেট্রিক টন। আর চলতি মৌসুমে এখনো আম রফতানি চলমান। অর্থবছর শেষে রফতানির পরিমাণ আরও বাড়বে।
দফতরটি বলছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী কৃষি অঞ্চল। এর মধ্যে নাটোর থেকে কোনো আম রফতানি হয় না। তবে বাকি ৩ জেলা থেকে এবার ১৭টি দেশে আম রফতানি হয়েছে। যা গত বছর ছিল ১২টি দেশ। এ বছর নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫টি দেশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাহরাইন, কাতার, ইতালি, হংকং, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, রাশিয়ায়, জার্মানি, ইংল্যান্ড, দুবাই, ইউরোপ ও নেদারল্যান্ডে আম রফতানি হয়েছে। এবছরে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে আম্রপালি জাতের আম। আর রফতানিতে নিজেদের জায়গা দখল করে আবারও শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নওগাঁ, তৃতীয় স্থানে রাজশাহী। চুক্তিবদ্ধ ৫৩ জন উৎপাদনকারী এই আম রফতানি করেছেন বলে জানায় দফতরটি।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, জেলায় ৩৩ লাখ ৬৪ হাজার আমগাছের মধ্যে লক্ষণভোগ জাতের গাছ সবচেয়ে বেশি। লক্ষণভোগ গাছ রয়েছে ৯ লাখ সাড়ে ৮১ হাজার। এ ছাড়া আম্রপালি গাছ ৫ লাখ ১ হাজার, খিরসাপাত ৪ লাখ সাড়ে ২২ হাজার, ফজলি ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০, আশ্বিনা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০, ল্যাংড়া ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০, গোপালভোগ ১ লাখ ৫১ হাজার ৫০০। ৯টি উপজেলার মধ্যে বাঘায় আমবাগানের সংখ্যা ও উৎপাদন সবচেয়ে বেশি।
জেলা কৃষি বিভাগের হিসাবে, গত চার বছরে আমের আবাদ বেড়েছে দুই হাজার হেক্টর জমিতে। পাশাপাশি বেড়েছে ফলন, মোট উৎপাদন ও বাণিজ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আম বাণিজ্যের আকার ছিল ৭০০ কোটি টাকার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৮৪৬ কোটি টাকার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার কোটি টাকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন আম, যার বাজারমূল্য ছিল ৭১৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন আম, যার বাজারমূল্য ছিল ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ লাখ ১ হাজার মেট্রিক টন আম। এর বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ২ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।
বাঘার আম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল ইসলাম ছানা বলেন, কয়েক বছর ধরে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করে আসছি। এই আম উৎপাদনে খরচ বেশি। পরিচর্যাও বেশি নিতে হয়। কারণ এই আম রফতানিকৃত দেশের শর্ত মেনে উৎপাদন করতে হয়। এ বছর তার উৎপাদনকৃত আম ইতালিসহ কয়েকটি দেশে গেছে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এমটিবি অ্যাগ্রো অ্যান্ড গার্ডেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহতাব আলী বলেন, আমাদের দেশের আম রাশিয়ায় রফতানি করা সহজ ছিল না। অনেক প্রচেষ্টার পরে সম্ভব হয়েছে। এই আম রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাশিয়ার দেওয়া শর্তগুলো পূরণ করা। তারা আমের মিষ্টতা, আকার সবকিছু শর্ত অনুযায়ী নিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, দেশের অন্যান্য জেলা ও দেশের বাইরে বাজারজাতকরণে আমে জিআই ট্যাগ ব্যবহার, জেলায় প্যাকেজিং হাউস তৈরি করা জরুরি। সরকারি পৃষ্টপোষকতা বৃদ্ধি পেলে রফতানিতে মাইল ফলক সৃষ্টি করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, এ অঞ্চল থেকে শুধু আম নয়, আম প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য উৎপাদন ও রফতানি এবং আমের বাইপ্রোডাক্ট রফতানির প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে এখানে প্যাকেজিং হাউজ ও টেস্টিং ল্যাব স্থাপন সময়ের দাবি। এছাড়া কার্গো বিমান চালুরও দাবি করে আসছি। দীর্ঘ সময় ধরে এসব দাবি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারকে জানানো হচ্ছে। দাবিগুলো বাস্তবায়ন হলে আম রফতানি আরও বাড়বে। আশা করি দ্রুত এর সমাধান আসবে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাজদার হোসেন বলেন, এবার শুরুতেই রাজশাহী থেকে বিদেশে আম রফতানি হয়েছে। আম পাড়ার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আম পাড়ার প্রথম দিনেই গুটি জাতের আম বাঘা থেকে ইতালিতে রফতানি হয়েছে। আম রফতানিতে এখানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ বলেন, প্রতি বছরই আম রফতানি বাড়ছে। রাজশাহীতে এবার আড়াই হাজার মেট্রিক টন নিরাপদ আম অর্থাৎ রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে। রফতানির মাধ্যমে আমের অর্থনীতির টেকসই হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে আমের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া এ অঞ্চলের আম স্বাদের দিক দিয়ে অন্য দেশগুলোর চেয়ে টেস্টি। এ কারণে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকেই ব্রান্ডিং করছে আম। রফতানির বিষয়টি এখন খুবই আলোচিত। নতুন নতুন ব্যবসায়ী এটার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং এখন আর আম রফতানি নিয়ে পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। আর চলতি মৌসুমে আম এখন রফতানি হচ্ছে।
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: