[email protected] সোমবার, ২১শে এপ্রিল ২০২৫, ৭ই বৈশাখ ১৪৩২

নির্বাচন প্রসঙ্গে কাছাকাছি বিএনপি-জামায়াত

আবু বকর সিদ্দিক

প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২৫, ২১:৫৫

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর লোগো

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব দেখা যাচ্ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে।

অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই দলের নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগারে নামেন।

মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও দুই দলের মতভেদ ছিল স্পষ্ট। বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও তাতে সুর মেলায়নি জামায়াত। বরং তারা এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে রাজি ছিল।

তবে লন্ডনে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান দেখা করে আসার পর তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

জামায়াত এখন আগামী রমজানের আগেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চাইছে; যা বিএনপির ডিসেম্বরের প্রায় কাছাকাছি।

এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তড়িঘড়ি নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। সংস্কারের পরেই জাতীয় নির্বাচন চাইছে তারা, সেজন্য আরও সময় দিতেও আপত্তি নেই তাদের।

এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও দাবি তুলেছে। বিএনপি আবার এর ঘোর বিরোধিতা করছে।

যাদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে অবসান ঘটে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমুল সংস্কারের দাবি তোলেন।

তাদের চাওয়া অনুসরণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নানা ক্ষেত্রে সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেন।

এর পাশাপাশি সবগুলো কমিশনের প্রধানদের নিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়। বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন।

ড. ইউনূস আগে থেকে বলে আসছিলেন, ন্যূনতম সংস্কার করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। আর ব্যাপক সংস্কার করলে নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে।

সর্বশেষ বুধবার বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের পরে যাবে না, বৈঠকের পর তা বলেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে ড. ইউনূসের কথায় অসন্তোষের কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেছেন, “তার (প্রধান উপদেষ্টার) বক্তব্যে আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই।”

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে বিএনপি ডিসেম্বরের কথাই বলে এসেছে বলে জানান ফখরুল।
ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বিএনপি এর আগে যখন বলেছিল, তখন জামায়াত নেতারা তাতে সমর্থন দেননি।

দুই দলের দূরত্ব বাড়ার মধ্যে সম্প্রতি লন্ডন যান জামায়াত আমির শফিকুর রহমান। সেখানে গত রবিবার তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার সঙ্গে দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরও ছিলেন।

এই বৈঠকে রাজনৈতিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে বিএনপির কোনও নেতা মুখ খোলেননি। এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা।

জামায়াত আমির শফিকুর একে সৌজন্য সাক্ষাৎ বললেও দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।

দৃশ্যত তার সেই কথার প্রতিফলনই দেখা গেল বুধবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিক এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হেরাপের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বৈঠকের পর।

তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াত আমির শফিকুর বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই দুই কর্মকর্তা ঢাকায় আসার পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তারাই প্রথম এদের দেখা পেলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নানা বিষয় জানতে চেয়েছেন জামায়াত নেতাদের কাছে। শফিকুর বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা কী, আগামী নির্বাচন কখন হবে, সেই সব বিষয়ে জানতে চেয়েছে তারা। সংখ্যালঘু, নারী, শ্রম ক্ষেত্রের বিষয়েও জানতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।

জামায়াত আমির বলেন, “আমরা যদি আগামীতে দেশের দায়িত্ব পাই, তাহলে ইকোনমিক পলিসি, ফরেন রিলেশন কী হবে, তা তারা জানতে চেয়েছেন।

“আমরা খোলামেলা কথা বলেছি। আমরা ডেমোক্রেটিক, আমরা দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করি, দেশ পরিচালনায়ও তা চাই।”

নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ জামায়াত চায় কি না, সেই বিষয়েও জানতে চেয়েছিলেন চুলিক ও হেরাপ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্নে জামায়াত আমির সরাসরি উত্তর এড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আওয়ামী লীগের বিচারটা অবশ্যই হতে হবে।”

নির্বাচনের সময় নিয়ে শফিকুর বলেন, “আমাদের ভিউ (অবস্থান) হচ্ছে, রমজানের আগেই তা শেষ হোক। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে আবার বর্ষা আসবে, ঝড়-ঝাপ্টা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন ইলেকশনটা আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।

“তাই আমরা চাইছি, সেই আশঙ্কার আগে রমজানের আগেই যেন ইলেকশনটা হয়ে যায়।”

এই বছর মার্চ মাসজুড়ে রমজান ছিল। হিজরি সনের সঙ্গে খিস্ট্রীয় বর্ষের দিনের পার্থক্যের কারণে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রমজান শুরুর কথা। সেই অনুযায়ী, জামায়াত মধ্য ফেব্রুয়ারির আগেই নির্বাচন চাইছে।

নির্বাচন এর পরে নিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন জামায়াত আমির। আর বিএনপি মহাসচিব বলছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা।

তিনি বুধবার বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।”

জামায়াত আমিরের বুধবারের কথায় সংস্কারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি, যা তাদের আগের বক্তব্যে থাকত।

বিএনপি ও জামায়াত কাছাকাছি চলে এলে সংস্কারে ওপর বেশি জোর দেওয়া দলের মধ্যে থাকছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

নবগঠিত এই দলটির নেতারা আগে থেকে বলে আসছেন, সংস্কার না করে নির্বাচন করলে আবারও একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের আবির্ভাবের ক্ষেত্র থেকেই যাবে।

বিএনপির নির্বাচন চাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা এটাও বলতেন, শুধু একটি ভোট আয়োজনের জন্য অভ্যুত্থান হয়নি।

বুধবার জামায়াতের পর এনসিপির নেতারাও দেখা করতে যান যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। সেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা রাষ্ট্র কাঠামোয় মৌলিক সংস্কারের আগে নির্বাচন চান না।

তার ভাষ্যে, “আমরা বলেছি, ন্যূনতম সংস্কার নয়, মৌলিক সংস্কার, রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্যই আমরা কাজ করছি। কোনও ধরনের পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।”

প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের ‘টাইম ফ্রেম’ প্রাথমিকভাবে সমর্থন করলেও নাহিদ বলেন, “কিন্তু নির্বাচনের আগে অবশ্যই কী কী কাজ করে নির্বাচনে যেতে হবে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

“বিশেষ করে বিচার, বিচারের রোডম্যাপ দেওয়া এবং সংস্কার ও জুলাই সনদ কার্যকর করা ইত্যাদি ব্যতীত নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলে আসলে লাভ নেই।”

সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে তাতে এনসিপি অংশ নেবে কি না, তা ‘বিবেচনাধীন থাকবে’ বলে জানান অভ্যুত্থানের নেতা নাহিদ।

এদিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে, যা এখনও সারা হয়নি এনসিপির। অন্যদিকে জামায়াতেরও নিবন্ধন নেই। এক যুগ আগে তাদের নিবন্ধন বাতিলের পর তা নিয়ে আইনি লড়াই চালাচ্ছে তারা, তবে মীমাংসা এখনও হয়নি।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর