প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২৪, ০০:৩৮
বছরের শুরু থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে দেশের আবহাওয়ায়। গত ৩ মাসে দেশবাসীকে বেশ ভুগিয়েছে অত্যাধিক তাপপ্রবাহ। ৩৫ দিনের টানা তাপপ্রবাহের পর যখনই স্বস্তি হিসেবে বৃষ্টি নেমে এসেছিল তখন সেই বৃষ্টির সঙ্গে আসা বজ্রপাত ঝরিয়েছে বহু প্রাণ। তারপর ঘূর্ণিঝড় রিমাল কেড়ে নিয়েছে পুরো উপকূলের মানুষের সম্পদ। সবশেষ সিলেটের বন্যাও বেশ ভুগিয়েছে মানুষকে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ৪ মাসেও স্বস্তিদায়ক আবহাওয়া পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
প্রতিটি মৌসুমের শুরুতে সেই মৌসুমের সিজনাল আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে বসে ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরামের সভা। এই সভার মাধ্যমে আবহাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে আসন্ন আবহাওয়ায় করণীয় নির্ধারণের আলোচনা হয়। সোমবার (১০ জুন) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ওই ফোরামের সভায় জানানো হয় আগামী ৪ মাসের আবহাওয়া কেমন থাকবে।
এতে বলা হয়, গত ৪ মাসে দেশের তাপমাত্রা বিগত সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াই উত্তপ্ত ছিল। এই অবস্থার জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, এলনিনোর প্রভাব, পশ্চিমা বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করাসহ অনেকগুলো কারণ জড়িত ছিল। তবে এলনিনো নিষ্ক্রিয় হয়ে সক্রিয় হচ্ছে লা নিনা। ফলে আগামী ৪ মাসে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। হতে পারে বন্যাও। তবে বৃষ্টিপাত হলেও তাপমাত্রা খুব একটা কমার সম্ভাবনা দেখছেন না আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার (১০ জুন) ঢাকার হলিডে ইন ঢাকা সিটি সেন্টার হোটেলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর এবং রিজিওনাল ইন্টারগেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম ফর আফ্রিকা অ্যান্ড এশিয়া (RIMES) এর যৌথ উদ্যোগে ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরাম- গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে এই তথ্য জানানো হয়। প্রতি বছর দুইবার ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরাম বা মনসুন ফোরাম আয়োজিত হয়। মূলত বর্ষা ও শীত মৌসুমের শুরুতে মৌসুমী পূর্বাভাস সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের জানাতে এবং আসন্ন মৌসুমকে সামনে রেখে বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এই পূর্বাভাস ব্যবহার করা হয়।
এই আলোকে বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমের (জুন-সেপ্টেম্বর) সম্ভাব্য পূর্বাভাসের একটা ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরাম গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন আয়োজিত হয়েছে। ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরাম গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন থেকে প্রাপ্ত ফলাফল- বৃষ্টিপাত, বন্যা ও অন্যান্য আবহাওয়াগত অবস্থার নিরিখে কৃষি ক্ষেত্রে খরিফ-২ (জুলাই-অক্টোবর) মৌসুমে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাত, যেমন- পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, নগর পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন, নৌ পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ফোরামে মৌসুমী পূর্বাভাস তৈরির জন্য বিভিন্ন বৈশ্বিক মডেলের পূর্বাভাসের উপর ভিত্তি করে এবং আঞ্চলিক ফোরাম সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরাম (SASCOF)-এর সমন্বয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও বর্ষাকালকে সামনে রেখে যাতে বিভিন্ন অধিদফতর (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, স্বাস্থ্য অধিদফতর, পানি সম্পদ অধিদফতর ইত্যাদি) দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও এ সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করতে পারে, পূর্বাভাস ব্যবহার করে নিজ নিজ খাতে পরিকল্পনা গ্রহণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং পূর্বাভাস ব্যবহারকারী ও প্রদানকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে – সেই লক্ষ্যেই এই ফোরাম আয়োজিত হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত পরিবেশ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম প্রধান অতিথি হিসেবে এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধান অতিথি ড. ফাহমিদা খানম পূর্বাভাসের ভিত্তিতে আরও বেশি ব্যবহারকারী-বান্ধব উপায়ে তথ্য উপস্থাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, কৃষির পাশাপাশি পরিবহন, স্বাস্থ্য, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, গাছপালার বৃদ্ধি, পরাগায়ন ও প্রজনন, বীমা ও কৃষিখাতের জন্য ক্ষুদ্রবীমাসহ সকল খাতের জন্য আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এ সংক্রান্ত তথ্যের উপযোগিতা রয়েছে। এজন্য আরও যথাযথ ও স্বল্পমেয়াদী (পাক্ষিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক ভিত্তিতে) পূর্বাভাস তৈরি করা এবং পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন মডেলের তথ্যের একত্রীকরণ জরুরি।
তিনি এই ফোরাম পরিচালনা ও পূর্বাভাস তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও RIMES-এর কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। পাশাপাশি, এই কার্যক্রমে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সংযুক্ত করা এবং নীতি-প্রণয়নকারী ও জনসাধারণের বোঝার ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণের উপযোগী করে পূর্বাভাস ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিবেদনগুলো প্রস্তুত ও সম্প্রচার করার জন্য সুপারিশ করেন।
অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রশ্নোত্তর পর্বে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টিপাত এবং কৃষি ও ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এগুলোর প্রভাব সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পূর্বাভাস জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার বাংলাদেশ, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, ইউএনডিপি, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, মাদার’স ড্রিম ফাউন্ডেশন, কারিতাস বাংলাদেশ, কর্ডএইড, প্র্যাক্টিকাল অ্যাকশন, জাইকা, ব্র্যাক সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ও অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।
ফোরামে RIMES এর উদ্যোগে এবং প্রধান খাতগুলোর (কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য ও নগর পরিকল্পনা) সহযোগিতায় পূর্বাভাস ভিত্তিক সাধারণ কিছু পরামর্শ ব্যবহারকারীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যা পরবর্তীকালে অংশগ্রহণকারীদের প্রদান করা হবে।
এছাড়াও, অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করেন এবং সতর্কীকরণ সংস্থাসমূহের বিভিন্ন কার্যক্রম কীভাবে আরও বেশি ফলপ্রসূ ও ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ-কেন্দ্রিক করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত মো. আজিজুর রহমান সমাপনী বক্তব্যে উল্লেখ করেন, এই ফোরাম পূর্বাভাস প্রস্তুতকারী ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমে আমরা ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনগুলো পর্যালোচনা করে ক্লাইমেট প্রোডাক্ট ও ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেমগুলোর সাহায্যে আরও বেশি কার্যকর পরামর্শ তৈরি করার প্রয়াস রাখি। ১৬তম ক্লাইমেট অ্যাপ্লিকেশন ফোরাম থেকে প্রাপ্ত মতামত ও সুপারিশগুলো মৌসুম-ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কার্যোদ্যোগে রূপান্তরিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্ব ব্যাংকের ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (CARE) ফর সাউথ এশিয়া প্রকল্প এই ফোরাম আয়োজনে সহযোগিতা করেছে। এটি ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদী একটি উদ্যোগ, যার লক্ষ্য হল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাতসহনশীল নীতিমালা ও বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে অবদান রাখা। তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক জলবায়ু-স্মার্ট নীতিমালা ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পের কম্পোনেন্ট-১ RIMES-কর্তৃক বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন: