প্রকাশিত:
১৫ আগষ্ট ২০২৩, ০৩:২০
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের শতকরা হারের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা খাত। গত বছর এ খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এরপর চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্প এবং বস্ত খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। তবে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের ওপর তৈরি প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সাল শেষে বিভিন্ন খাতে ব্যাংকগুলো ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ১২ লাখ ১৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিমাণের দিক থেকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে। আর শতকারে হারে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি জাহাজ নির্মাণ খাতে। ২০২২ সাল শেষে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২৮ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ খেলাপি। ২০২১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। গত বছর এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।
২০২২ সাল শেষে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হারে এই খাতটি গত বছরও শীর্ষে ছিল।
খেলাপি ঋণের হারের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্পে। আর পরিমাণের দিক থেকে তৈরি পোশাক খাত। ২০২২ সাল শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত বছর এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
২০২২ সাল শেষে তৈরি পোশাক খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এ খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণের দিক থেকে তৃতীয় বস্ত্র খাত। গত বছর শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২১ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এক বছরে বস্ত্র খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যা পরিমাণের দিক থেকে সব খাতের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
এছাড়া ২০২২ সালে ক্রেডিট কার্ড, পরিবহন খাত ও ব্যক্তির বাড়ি নির্মাণ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২১ সালে ক্রেডিট কার্ডে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫০ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৬৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায় বা ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর পরিবহন খাতে গত বছর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ০১ শতাংশ। এছাড়া ব্যক্তির বাড়ি নির্মাণ খাতে ২০২১ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৩৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
তবে গত বছর কিছু খাতে খেলাপি ঋণ কমার তথ্যও মিলেছে। প্রতিবেদন বলছে, গত বছর পর্যন্ত কৃষি খাতে ঋণ গেছে ৫৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ছিল ৩ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। এর মানে কৃষকরা ঋণ ফেরত দিয়েছেন বেশি।
এছাড়া গত বছর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও ব্যাংকের ঋণখেলাপি কমেছে। ২০২১ সাল শেষে এ খাতে ৫৩৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ; যা ২০২২ সালে কমে ৩৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে মোট খেলাপি ঋণের ৬৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছিল ১০ ব্যাংকে। বাকি ৫১টি ব্যাংকে ছিল ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তুলনামূলকভাবে কম খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু ব্যাংক খাতে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এতে আর্থিক খাতের সম্পদের মান খারাপ হয়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ছিল। যার ফলে ঋণ নবায়নের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক খাতে সম্পদ ও খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। এতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে। ঋণের প্রবাহ কয়েকটি ব্যাংকে বেশি, যে কারণে এসব ব্যাংকের কারণে ঝুঁকির মাত্রাও বেশি।
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: