[email protected] শনিবার, ২৩শে নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

‘মিধিলি’তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ফসলের

জাতীয় ডেস্ক

প্রকাশিত:
১৮ নভেম্বার ২০২৩, ১১:৪০

ফাইল ছবি

সারাদেশে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে বিদায় নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূল পেরিয়ে দুর্বল হলেও দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলায় ঝড়টি কমবেশি আঁচড় কেটেছে। কক্সবাজারের টেকনাফে বসতঘরের মাটির দেয়ালচাপায় এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।

টাঙ্গাইলে গা‌ছের ডাল ভে‌ঙে পড়ে এক ব‌্যবসায়ীর মৃত্যু হ‌য়ে‌ছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মিরসরাইয়ে শিশুসহ মারা গেছেন দু’জন। বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভেঙে গেছে কাঁচা ঘর। ডুবে গেছে বেশ কিছু ট্রলার। বিচ্ছিন্ন ছিল বৈদ্যুতিক সংযোগ। রাতভর বিদ্যুৎহীন ছিল অনেক এলাকা। 

ঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ ছিল। মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের কানাইনগরসংলগ্ন এলাকায় ডুবে গেছে কয়লাবোঝাই একটি লাইটার জাহাজ। ব্যাহত হয়েছে বিমান চলাচল। বন্ধ ছিল নৌযান চলাচল।

টানা বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মাঠের ফসলের। অনেক এলাকায় পাকা আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছে। 

ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে বিকেল ৩টার দিকে তা পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে। পটুয়াখালীতে বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ ঘূর্ণিঝড় উপকূল এলাকা অতিক্রম করেছে।

রাতে ঘূর্ণিবায়ুর চক্র স্থলভাগের ওপর দিয়ে আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হতে হতে এক পর্যায়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও কাছাকাছি দ্বীপ এবং চর এলাকার ওপর দিয়ে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর খুবই উত্তাল ছিল। মিধিলি খুব বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় হবে না বলে আগে থেকে জানিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদরা। এটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।

ঝড়ের বিপদ কমে আসায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, জানমাল বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন নারী ও শিশুসহ উপকূলের ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনও আসেনি। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, মানুষকে সাবধান করার জন্য আমরা বিপৎসংকেত দিয়েছি। তবে এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় নয়, খুবই দুর্বল প্রকৃতির।

ঝড়ের কারণে গতকাল সদরঘাট থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে এগিয়ে আসতে থাকায় ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলার পর পণ্য ওঠানামা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারি করা হয়। পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ ছিল মোংলা বন্দরেও। 

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হানিফ মাঝির বাড়ির আবদুল ওহাব নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে তিনি মারা যান।

মিরসরাইয়ে জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনা পাহাড়া এলাকায় গাছ উপড়ে পড়ে তিন বছর বয়সী শিশু সিদরাতুল মুনতাহার মৃত্যু হয়েছে। বাড়ির উঠানে খেলার সময় একটি গাছ শিশুটির ওপর উপড়ে পড়ে। চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার, বাকলিয়া, বহদ্দারহাটসহ নিচু এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। 

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় বসতঘরের মাটির দেয়ালচাপায় এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া নামক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন– ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পানিরছড়ার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)। গতকাল দুপুরে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে ঝোড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রাজ্জাক মিয়া (৪০) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ১৫টি ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে। ট্রলারগুলোর সঙ্গে ট্রলার মালিক সমিতি কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না। এসব ট্রলারে ছিলেন আনুমানিক ২০০ জেলে। মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের কানাইনগরসংলগ্ন এলাকায় কয়লাবোঝাই লাইটার জাহাজ এমভি প্রিন্স অব ঘষিয়াখালী-১ ডুবে গেছে।

এ সময় সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন ডুবে যাওয়া লাইটারের ১১ কর্মচারী। লাইটার এমভি প্রিন্স অব ঘষিয়াখালী মোংলা বন্দরের হাড়বাড়িয়া এলাকায় অবস্থান করা একটি জাহাজ থেকে কয়লা বোঝাই করে যশোরের নোয়াপাড়া ঘাটে যাচ্ছিল। গতকাল দুপুর আড়াইটায় লাইটারটি তীব্র বাতাসের কবলে পড়ে ডুবোচরে আটকে তলা ফেটে ডুবে যায়। 

পিরোজপুরে সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসের কারণে ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের। গাছের গোড়ায় পানি জমে শাকসবজিতে পচন ধরার আশঙ্কা রয়েছে। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় অসংখ্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমন ধান, পানের বরজ ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কীভাবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন, সেটা নিয়ে চিন্তিত কৃষক। 

ঝড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় রেললাইনে গাছ উপড়ে পড়ায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী ও সিলেটের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপজেলার কালীসীমা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহর স্টেশনে এবং নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্টেশনে আটকা পড়েছে। গাছ সরানোর পর রাত সাড়ে ৮টা থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার জসিম উদ্দিন সমকালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক নুর কুতুবুল আলম জানান, জেলায় বেশকিছু গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া আমনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাগেরহাটে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ধানের বীজতলা। বিপুল পরিমাণ ফসলি জমিও নিমজ্জিত রয়েছে পানিতে।

বেশকিছু এলাকায় আধাপাকা আমন ধান নুয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বিভিন্ন স্থানে কাঁচা বসতঘর বিধ্বস্ত হওয়াসহ অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঝোড়ো হাওয়ায় পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উপজেলায় সকাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

বরিশালে বেলা ১১টার পর পুরো জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরের সদর রোড এলাকায় বিদ্যুৎ চালু হলেও অন্যান্য এলাকা ও জেলার সর্বত্র বিদ্যুৎহীন রয়েছে। পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নদীতীরবর্তী ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় অর্ধ লাখ বাসিন্দা আতঙ্কে আছেন।

ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে লাগাতার বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে ঝালকাঠিতে। এতে গাছপালা উপড়ে পড়ায় জেলা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় তীব্র বাতাসে মেঘনা নদীর তীরে থাকা অর্ধশতাধিক মাছ ধরার ছোট-বড় নৌকা বিধ্বস্ত হয়েছে।

বেশ ক’টি নৌকা ডুবে যায়। ওই এলাকার অন্তত ২০টি কাঁচাঘর ভেঙে গেছে। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক গাছ উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। অনেক স্থানে ঘরবাড়িরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া হেলে পড়েছে পাকা ধান।

হাতিয়া উপজেলার কৃষক কেফায়েত হোসেন বলেন, এবার আমন ধানের ফলন ভালো হলেও সব ধান ঘরে তুলতে পারিনি। আজকের ঝড়ে অনেক ধান হেলে পড়েছে। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হবে। হাতিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল বাসেদ সবুজ জানান, প্রায় ২০ শতাংশ আমন ধান হেলে পড়েছে।

ভোলার চরাঞ্চলে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মনপুরা, তজমুদ্দিন ও সদরের ইলিশার মেঘনা নদীতে ১১ জেলেসহ তিনটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া ট্রলারের ১০ মাঝিমাল্লা উদ্ধার হলেও তজুমদ্দিনের মলংচড়ার বাসু মাঝি নামের এক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। সূূত্র: সমকাল।

বাংলা গেজেট/এফএস


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর