প্রকাশিত:
১০ আগষ্ট ২০২৩, ২২:৫৬
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে অনেকদিন ধরেই কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক কর্মসূচি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২৮ জুলাইয়ে নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ। লাখো নেতাকর্মী জড়ো হয়েছিল সেদিনের কর্মসূচিতে। সে তুলনায় পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ছিল অনেকটা কর্মীশূন্য। অবস্থান কর্মসূচিতে প্রতিটি পয়েন্টে দলটির নেতারা ২৫ থেকে ৩০ হাজার নেতাকর্মী জমায়েতের আশা করলেও তা ‘আশায় গুড়ে বালি’ হয়।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের অভূতপূর্ব উপস্থিতির পরদিন অবস্থান কর্মসূচি ঠিকমতো পালন করা গেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেত পারত। ঢাকার প্রবেশপথের প্রতিটি পয়েন্টে ২৫ থেকে ৩০ হাজার নেতাকর্মী জড়ো করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সাংগঠনিক ব্যর্থতা ও দায়িত্বশীলদের সমন্বয়হীনতার কারণে সেদিনের কর্মসূচি সেই অর্থে জোরাল হয়নি বলে মনে করছেন অনেকে।
দলটির অনেক নেতাকর্মীর মতে, সেদিনের বিষয়টি মাঠের কর্মীদের মনোবলে আঘাত হেনেছে। যার ফলে আন্দোলনে এক রকমের ছন্দপতন হয়েছে। সেজন্য আগামীর আন্দোলনে দায়িত্বশীলদের সক্রিয় থাকা নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। ছাত্রদল সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
সমন্বয়হীনতা ও যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে। দলের হাইকমান্ড থেকে মৌখিকভাবে তিরষ্কার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন নেতাকেও।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে- আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে দলের ভেতরে জোরালো আলোচনা চলছে।
অবস্থান কর্মসূচির পর কিছুটা বিরতি দেওয়া হয়েছে আন্দোলন কর্মসূচিতে। এই সময়ে কর্মসূচিগুলোতে নেতাদের অবদান মূল্যায়ন করেছেন দলটির হাইকমান্ড। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে দল ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের ভূমিকা নিয়ে। একই সঙ্গে ঢাকার অবস্থান কর্মসূচিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা নেতাদের প্রশংসাও করেছে দলীয় হাইকমান্ড।
সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের হাতে নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন রিপোর্ট রয়েছে। তার নির্দেশনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির দিনে নির্ধারিত স্পটে যাননি স্থায়ী কমিটির ৩ জন সদস্য। তাদের থাকার কথা ছিল তিনটি স্পটের প্রধান দায়িত্বে। কয়েকজন ভাইস চেয়ারম্যানকেও পাওয়া যায়নি দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পটে। কর্মসূচির স্পটে পরিস্থিতি বুঝে ফিরে গেছেন ৪ জন যুগ্ম সম্পাদক। ২ জন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন না তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত জায়গায়। উত্তরায় পুলিশ ধাওয়া দিলে সরে গিয়েছেন একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। গাবতলীর দায়িত্বে থাকা একজন নেতার সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও এসেছে মূল্যায়ন রিপোর্টে। ঢাকা জেলা বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতাও দায়িত্বে অবহেলা করেছেন সেদিন।
তবে নিপুণ রায়ের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মাতুয়াইলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের নেতাদের। সেখানে দায়িত্ব প্রাপ্তদের কেউ না যাওয়ার বিষয়টিও মূল্যায়ন করা হচ্ছে দলীয়ভাবে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা বলেছেন, কর্মসূচি সফল করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথা বলেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। এ সময় অনুপস্থিতি ও সমন্বয়হীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি কেন কর্মসূচি সফল করা যায়নি? এনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির একাধিক নেতা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন- দলের নেতাদের কারও ‘সদিচ্ছার অভাব ছিল না, কিন্তু সমন্বয়হীনতা’ ছিল।
গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, অনেকে হয়তো নানা বাস্তব কারণেই যথাসময়ে নির্ধারিত স্পটে আসতে পারেনি। কিন্তু একটি ঘটনার পর অন্য কেউ হাল ধরে বাকিদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেনি। গাবতলীর ঘটনাই দেখুন। আমান সাহেব আটক হওয়ার পর আর কেউ দায়িত্ব নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কমিউনিকেট করেনি।
অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন গয়েশ্বর। গয়েশ্বর ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়।
২৮ ও ২৯ জুলাই পরপর দুটি কর্মসূচি নিয়ে কথা হয় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে। তারা জানান, ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল বিপুল কর্মী-সমর্থক নিয়ে আরেকটি বড় শোডাউন করা। কিন্তু তা হয়নি। কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের যে অনীহা ছিল তা ফুটে উঠেছে ৩১ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমান উল্লাহ আমানের ভাষণে। সেদিন দলের স্থায়ী কমিটির সব সদস্যকে কর্মসূচির সময় মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
এর আগে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে পুরো কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতের শিলংয়ে থাকা স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে কে কোথায় অবস্থান করবেন এবং কেউ বাধাপ্রাপ্ত হলে কারা এগিয়ে যাবেন- সে বিষয়ে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।
পরিকল্পনায় বলা হয়, সিনিয়র নেতারা মূল পয়েন্টগুলোতে থাকবেন। কিন্তু কর্মী-সমর্থকদের জমায়েত সফল করা এবং ‘বাধার মুখে টিকে থাকার’ বিষয়টি সহযোগী সংগঠন এবং মহানগরীর নেতারা দেখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেতাদের অনুপস্থিতিতে ভেস্তে গেল কর্মসূচি সফলের আশা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একাধিক নেতা জানান, বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনকে ক্ষুব্ধ করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তার বৈঠকে।
এর আগে বিভিন্ন স্পটের ভিডিও দেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কে কোথায় ছিলেন সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেন তারেক রহমান নিজেই। এমন পরিস্থিতিতে ‘দ্রুত নিজেদের মধ্যে ঝামেলা’ মিটিয়ে নিতে দলীয় নেতাদের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। এছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কয়েকজনের সঙ্গে নিজে কথা বলেছেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন বলে দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বলেছেন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারমুখী অবস্থানসহ নানা বাস্তবতায় অনেকে চেষ্টা করেও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেন না অনেক সময়। তার মানে এই নয় যে বিষয়টি দলের মধ্যে কোনো হতাশা তৈরি করেছে।
রুহুল কুদ্দুস বলেন, সিনিয়র নেতারা অনেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাদের পক্ষে মাঠে নামা কঠিন। কিন্তু তাদের নেতৃত্বও দলের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
তার মতে- রাজনৈতিক দলে এটি স্বাভাবিক চিত্র। দল নিয়মিতই অবস্থা পর্যালোচনা করছে ও করবে। অনেক সময় কৌশলও পাল্টাতে হয়। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের কর্মী সমর্থকরা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ওই কর্মসূচির এক সপ্তাহের মাথায় অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে। যা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
জানা গেছে, অসুস্থ বলা হলেও তিনি সুস্থ ছিলেন। অব্যাহতির দিনও তিনি দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। এরপরই খবর ছড়িয়ে পড়ে অবস্থান কর্মসূচিতে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন না করা নেতাদের বিরুদ্ধে ‘সাংগঠনিক ব্যবস্থা’ এভাবেই নেওয়া হতে পারে।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার অবশ্য বলছেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন দলের স্বার্থে যে কাউকেই তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন বা কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু নেতারা যা-ই বলুন না কেন দলের অভ্যন্তরে এখন বড় আলোচনার বিষয় হলো– সমাবেশগুলোতে বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেও ‘বাধা আসতে পারে’ এমন কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আনা যাচ্ছে না কেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলছেন, সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণ হয় বলে সেখানে সব বয়সের মানুষ উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু যেসব কর্মসূচিতে ‘পুলিশ বা সরকারি দলের হামলার’ সম্ভাবনা থাকে সেখানে সেটা সম্ভব হয় না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, সবাই তো সব কর্মসূচিতে থাকতে পারবে না। তবে এখন যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে সেটার যৌক্তিক কারণও আছে। অনেকে মামলার কারণে আত্মগোপনে। ফোনে কথা বলাও রিস্ক হয়ে যায় অনেক সময়।
তবে নেতারা মনে করছেন- সমন্বয়হীনতা ও অনীহার বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের নজরে আসায় এবং দল থেকে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ায় সামনের কর্মসূচিগুলো আরও সুসংগঠিত হবে এবং তাতে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণও বাড়বে।
বাংলা গেজেট/এমএএইচ
মন্তব্য করুন: