বাংলাদেশ ও আইএমএফ ঋণ: সংকট ও সম্ভাবনা

১৯৯৭ সাল:
কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে হঠাৎ করেই শ্রমিকদের মাঝে আত্মহত্যার হার হু হু করে বেড়ে যায় ।ঘটনাটি কিন্তু খুব বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এই দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে দ্বারস্থ হয়ে ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর। এরপর ঋণের শর্তের ঘানি টানতে গিয়ে তাদের বন্ধ করে দিতে হলো বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান ।ফলে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে হতাশায় মৃত্যুকে আপন করে নেওয়া শুরু করে ।
ঠিক একই সালে পূর্ব এশিয়ার আরেকটি দেশের সরকার ঠিক করলো তারা আইএমএফ এর দ্বারস্থ হবে না। নিজেদের মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে তারা ঋণের বোঝা না নিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সিস্টেমের ত্রুটি সংশোধনকেই অধিক গুরুত্ব দিলো এবং তারা নিজেদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ,সামর্থ্য ও অঙ্গীকারে র জায়গা থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার করে আইএমএফের দ্বারস্থ না হয়েই সংকট হতে মুক্তি পেলো।
দেশটি হলো মালয়েশিয়া। দেশটি তখনকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ মনে করতেন আইএমএফ হতে ঋণ নেওয়া মানে হলো নিজের দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরাধীনতা তৈরী হওয়া। কেননা তখন যেকোনো নীতিনির্ধারনী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আর স্বাধীন থাকে না বরং তাকে আইএমএফের দেওয়া শর্ত মেনেই সকল কাজ করে যেতে হয়।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে -
আইএমএফ থেকে এবার ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের শর্তসমহূ পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে দুই ধরণের প্রভাব পড়তে পারে।বাংলাদেশের উপর আইএমএফ ঋণে র তাৎক্ষণি ক প্রভাব আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজস্ব আয় বাড়ানো,ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ,খেলাপী ঋণ কমানো,ভর্তুকি কমানোর মতো শর্তগুলো আরোপ করেছে।
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে বাংলাদেশ সময় মতো আইএমএফর কাছে ঋণের জন্য গেছে । নাগেলে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারতো। শ্রীলঙ্কা তা পারেনি , সেজন্য তারা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে । আপাত দৃষ্টিতে দেখলে আইএমএফ এর শর্তগুলো বেশ ভালো শর্ত হিসেবেই ঠেকে।
কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে -
আইএমএফের শর্তগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তা দেশের সাধারণ জনগনের স্বার্থের সাথে প্রায়শই সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে । কেননা দিনশেষে আইএমএফ একটি ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়াই এর অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু এই ঋণ এর শর্ত সমহূ এদেশের প্রেক্ষাপটে কেমন প্রভাব ফেলবে এবং তা দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে কিনা তা এটির মলূ চিন্তার বিষয় নয়।
এই যেমন , ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে বিদ্যুৎ ,পানি ,গ্যাস,সার এ। এই ভর্তুকি কমানো হলে এতে বিদ্যুৎ,গ্যাস আর পানির মতো নিত্যব্যবহার্য পন্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাবে ।ফলে সাধারণ মানষেুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে বহুগুন। ইতোমধ্যেই আইএমএফের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ এবং সাথে সাথে ই বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
নিত্যব্যবহার্য্য সব জিনিসের ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানো হলে ও সাধারণ মানুষের আয় কিন্তু একই হারে বাড়বে না।ফলে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে টিসিবির পণ্যের জন্য লাইন। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো হলে বিপাকে পড়বে কৃষকশ্রেণী। বেড়ে যাবে ফসলের উৎপাদন ব্যয়। একইসাথে বাড়বে বাজারে খাদ্যের দাম।
সুতরাং,স্বল্পমেয়াদে এই ঋণ আসলে এদেশের সাধারণ জনগণের কষ্ট বাড়িয়ে তুলবে বেশ খানিকটা।
এখন প্রশ্ন আসে দারিদ্র-সংকট নিরসনে আইএমএফ এর শর্ত কেন অকার্যকরী?
ভর্তুকি কমানোর ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি কমাতে আইএমএফ প্রস্তাব করেছে লক্ষ্যভিত্তিক ভর্তুকি (Targeted Subsidy) ব্যবস্থা প্রবর্তনের। কিন্তু বাংলাদেশের মতে শাসনব্যবস্থা নিয়ে চরম সমালোচনা রয়েছে এমন একটি দেশের প্রেক্ষাপটে এটি কতোটা বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উদাহরণস্বরূপ,দুর্নীতিতে জর্জরিত এই দেশে করোনা মোকাবেলা সরকারের নানা প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়েও হয়েছে মারাত্মক আকারের দুর্নীতিতে জর্জরিত ,যার ফলে প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য প্রদানের পরিকল্পনা সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
খেলাপী ঋণের পরিমান ২১ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার একটি শর্তও আইএমএফ দিয়েছে। এখন এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে ঋণ খেলাপীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে কতটা কার্যসিদ্ধি করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে ।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে কাগজে কলমে খেলাপী ঋণের পরিমাণ কম দেখিয়ে আইএমএফের দেয়া শর্ত পূরণ করা হবে যার ফলে ঋণ খেলাপীরাই আরও সুবিধা পেয়ে যাবে।
এদেশে যারা কর ফাঁকি দিয়ে থাকে সেই সকল রাঘব বোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে বারবারই অপারগ হয়েছে সরকার। তাই যখন শর্ত মোতাবেক রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে তখন আসলে নিয়মিত করদাতাদের উপরেই আরও বেশী কর চাপানো হবে। ফলে আবারও এদেশের সাধারণ জনগণরাই পড়বে বিপাকে ।
সরকারের দরূদর্শীতা,সামর্থ্য ,কর্মপর্মরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইএমএফ এর ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে আসলে দেশের সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে।
আইএমএফ এর প্রস্তাবিত শর্তগুলো বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করতে আহবান জানায়। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব আমরা স্বচক্ষে বেশী দেখে থাকি। যেমন,মক্তু বাজার অর্থনীতির ফলে বিদেশী পণ্যের উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা তৈরী হওয়ায় দেশে সেইসব পণ্যের বাজার তৈরী হচ্ছে না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে আমদানী ব্যয়।
তবে একথাও সত্য যে বিশ্বায়নের মাঝে লকিুকিয়ে আছে দেশের অর্থনীতির জন্য নানান সম্ভাবনা। বিশ্বায়নের ফলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে ও নিজেদের বাজার তৈরীর সুযোগ পাচ্ছে যার ফলে দেশে আসছে বিদেশী মদ্রুা।আইএমএফ এর ঋণ ও বিশ্বায়নকে পুজিঁ করে দেশেই সকল আমদানি পণ্যের বাজার তৈরী করতে হবে , উৎপাদন বাড়াতে হবে ,ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটাতে হবে ,রপ্তানী বাড়াতে হবে। তবেই উন্নয়ন হবে টেকসই। আইএমএফ এর ঋণকে বিশ্বায়নের সাথে সম্পর্কিত এমন সব খাতে ব্যবহার করে এই খাতগুলোকে শক্তিশালী করা গেলে বাংলাদেশের জন্য তা মঙ্গল বয়ে আনবে।
আইএমএফ ঋণের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
এবার ঋণের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশ আসলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকি মোকাবেলায় এই ঋণ নিয়েছে। তারা শ্রী-লংকা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হয়ে বল-আউটের আবেদন করে নি বরং সম্ভাব্য ঝুঁকির আগেই সতর্ক হতে চেয়েছে।
আইএমএফের ঋণের ফলে এদেশের রিজার্ভের ঘাটতি সাময়িক পূরণ হয়েছে একথা কিন্তু সত্য। একই সাথে সত্য এটিও যে এই ঋণের ফলে অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে ঋণ পাবার পথও কিছুটা সুগম হয়েছে। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ আবারও পরি ত হলো একটি দাতা নির্ভর রাষ্ট্রে। পর্যাপ্ত পরিমাণে রপ্তানী ও বিনিয়োগ না বাড়লে এবং রেমিট্যান্স না এলে ডলার সংকট সাময়িক কাটলে ও দীর্ঘমেয়াদে দেশের সংকট আরোও গভীরতর হবে। কেননা এই ঋণের অর্থের একটি অংশ আইএমএফকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া লাগবে বাংলাদেশে।
কিন্তু এর ফলে বাংলাদশ আবারও পরিণত হলো একটি দাতা নির্ভর রাষ্ট্রে। পর্যাপ্ত পরিমাণে রপ্তানী ও বিনিয়োগ না বাড়লে এবং রেমিট্যান্স না এলে ডলার সংকট সাময়িক কাটলে ও দীর্ঘমেয়াদে দেশের সংকট আরোও গভীরতর হবে। কেননা এই ঋণের অর্থের একটি অংশ আইএমএফকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া লাগবে বাংলাদেশর।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে এবং পরিবেশের উন্নয়নে সে যকল পদক্ষেপের কথা আইএমএফ বলেছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ,দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের নানা গাফিলতি , অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ যে সকল ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছিলো সেগুলো থেকে ছিটকে পড়েছে ।পুজিঁজিপাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ চাপ সৃষ্টি হয়েছে । ফলে শুরু হয়েছে রিজার্ভ পতনের ধারা যা সুষ্ঠ দক্ষতার অভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না সরকার। এই ধারা বন্ধ করা না গেলে আসলে দেশের দিকে ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটকে থামানো কঠিন হয়ে পড়বে ।
আমরা যদি আইএমএফ এর ঋণ কর্মসূচির ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে এই ঋণ নিয়ে নিজেদের বিপদ কাটিয়ে উঠেছে এমন দেশের উদাহরণ খুব একটা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি আইএমএফের ঋণ এবং নিজেদের দুর্নীতির ফলে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি ধসে যাবার উদাহরণ আমরা দেখি । তবে ইন্দোনেশিয়া,ভারত,দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পরও নিজেদের অর্থনীতির নানা সংস্কার করতে পেরেছে বলেই নিজেদের সংকট এক পর্যায়ে কাটিয়ে বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থানে যেতে সমর্থ হয়েছে ।
অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মইনলু ইসলামের মতে ,আমাদের রিজার্ভ কমছে মলূত ৪টি কারণে । আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফিরিয়ে না আনা এবং ব্যাংক থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাওয়া।
কিন্তু আইএমএফের শর্তগুলোর একটিও আসলে এই কারণগুলো সমাধানের চেষ্টা করে না। তাই, শুধুমাত্র আইএমএফের ঋণ নিয়ে এবং তাদের বাতলে দেওয়া কর্মসূচি পালন করে সাময়িক অর্থনৈতিক স্বস্তি মিললে ও এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। বরং , অর্থনৈতিক সংকটের যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে রিজার্ভ পতনের যেই বিপজ্জনক ধারা শুরু হয়েছে তা রুখতে পারার সম্ভাবনার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির রূপ রেখা।
তথ্যসূত্রঃ
দ্য ডিপ্লোম্যাট
লেখা-
নাফিসা ইসলাম মেঘা
শিক্ষার্থী ,৩য় বর্ষ,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: